এনসিপির সমাবেশ কেন্দ্র করে সহিংসতা

গোপালগঞ্জে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে: আসক

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গুলিতে পাঁচ নাগরিক নিহত, বহু সংখ্যক আহত এবং পরবর্তীতে গণআটক-গ্রেপ্তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

সংস্থাটির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল দুই দিনব্যাপী প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান শেষে বলছে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া, রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা-সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। আজ শুক্রবার আসক নিজেদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে।

এর আগে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল ২১ ও ২২ জুলাই গোপালগঞ্জে নিহত, আহত, আটক ও গ্রেপ্তার নাগরিকদের পরিবার, স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী এবং কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সমাবেশ শুরুর পূর্ববর্তী হামলা এবং সমাবেশের পরবর্তী সময়ের সংঘর্ষের ঘটনায় হামলাকারীদের পক্ষ থেকে তীব্র ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনার কথা জানা গেছে এবং কারও কারও হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল বলে জানা যায়। হামলার সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও হামলাকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।

আসক মনে করে, 'গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে।'

প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, এনসিপি নেতারা স্বল্প সংখ্যক সমর্থকদের উপস্থিতিতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এই মন্তব্যের পরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় 'সাধারণ জনতা' রাস্তায় নেমে আসে, এক পর্যায়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

প্রতিবেদন অনুসারে, গোপালগঞ্জ জেলায় ১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা চলাকালে নির্বিচারে নাগরিকদের আটক ও গ্রেপ্তার করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মতো অভিযোগও উঠেছে। ভয়ে মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকছে। নিরাপরাধ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

'সমাবেশের আগের দিন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাবেশস্থলের কাছের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশাসনের নির্দেশে দোকানপাট বন্ধ রাখেন দোকান মালিকেরা,' উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

সমাবেশস্থলের কাছাকাছি এলাকার ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে আসক আরও জানিয়েছে, 'সমাবেশের দিন সকালে প্রশাসনের লোকজন জোরপূর্বক দোকান বন্ধ করে দেয় এবং কোথাও কোথাও দোকানের শাটার নামিয়ে দোকানের ভেতরে থাকা মানুষদের আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে।'

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সমাবেশের দিন সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাদের হাতে লাঠি-সোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল।

সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), ইমন তালুকদার (১৭) ও সোহেল মোল্লা (৩২) এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ আরেক ব্যক্তি রমজান মুন্সী ১৮ জুলাই মারা যান। আসকের অনুসন্ধান দল নিশ্চিত হয়েছে, এই পাঁচজনের মধ্যে শুধুমাত্র রমজান মুন্সীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

আসক রমজান মুন্সীর সুরতহাল প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে এবং প্রতিবেদনে শরীরে গুলির চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।

নিহত ইমন তালুকদারের পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে আসক জানিয়েছে, 'ঘটনার দিনে আনুমানিক দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তারা হাসপাতালে ছুটে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকেল ৫টার দিকে মরদেহ দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য হয়েছেন।'

ইমনের স্বজন আরও বলেছেন, 'ইমনের শরীরে গুলির চিহ্ন এবং শরীরের মুখমণ্ডলসহ নানা স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল।'

'ইমন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, সে স্থানীয় ভেড়াবাজার এলাকার একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করতো,' জানিয়েছে তার স্বজনরা।

একই অভিযোগ করেছে নিহত রমজান কাজী, দীপ্ত সাহা ও সোহেল মোল্লার পরিবার। তারা জানান, হাসপাতাল থেকে দ্রুত মরদেহ নিয়ে দাফন বা সৎকারের তাগিদ দেওয়া হয়। যার কারণে তারা মরদেহ নিয়ে এলাকায় চলে যান।

ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ দাফন ও সৎকারের বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে গত ২০ জুলাই পুলিশের পক্ষ থেকে দীপ্ত সাহার পরিবার ছাড়া অন্য তিনটি পরিবারকে জানানো হয়, পরিবারের সদস্যরা যেন ২১ জুলাই কবরস্থানে সকাল ১০টায় উপস্থিত থাকেন, মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হবে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জুলাই কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। রমজান কাজী ও ইমনের মরদেহ উত্তোলন ও সুরতহাল প্রক্রিয়ায় সরেজমিনে উপস্থিত ছিল আসকের প্রতিনিধি দল। পরিবারগুলো এই প্রক্রিয়াকে নতুন এক ধরনের হয়রানি বলে মনে করেন।

আসকের প্রতিনিধি দলকে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন একজন জানান, তার পেটে ও হাতে গুলি লেগেছে, হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি ব্যাটারিচালিত রিকসায় তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে তিনি আহত হন। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।

এছাড়া, ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ১৮ শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর আওতায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে আসকের তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

শিশুদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় ২১ জুলাই পর্যন্ত মোট আটটি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি মামলার কপি আসকের হাতে এসেছে।

কপিগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলায় পাঁচ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫৮ আসামির। এসব আসামিদের মধ্যে তিনজন নারী এবং ৩২ জন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন।

এই ছয়টি মামলার মধ্যে তিনটি সন্ত্রাসবিরোধী আইন, একটি দণ্ডবিধি অনুযায়ী ও একটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা হয়েছে।

রমজান কাজী ও দীপ্ত সাহার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছে পুলিশ। এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।

তবে, আসকের প্রতিনিধি দলের কাছে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, পরিবারের সঙ্গে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রশাসন বা পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ কখনো যোগাযোগ করেনি।

আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ২৪ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১ জন সাধারণ নাগরিক, দুইজন পুলিশ সদস্য এবং গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আসককে জানান, ১৬ জুলাই দুপুর থেকে মোট চারজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তাদেরকে 'ব্রড ডেথ' ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

দীপ্ত সাহাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্তত দুইজন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কাছে দাবি করেন, যখন দীপ্ত সাহাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দীপ্ত সাহা বেঁচে ছিলেন এবং তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দীপ্তকে অপেরেশন থিয়েটারেও নিয়ে যাওয়া হয়। এর কিছু সময় পর ডাক্তার দীপ্তকে মৃত ঘোষণা করেন। কাজেই 'ব্রড ডেথ' ঘোষণা করার কথাটা ঠিক নয়।

আহতদের মধ্যে মোট কতজন গুলিবিদ্ধ ছিলেন জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আসককে বলেন, 'ঠিক এভাবে বলা যাবে না, গুলির বিষয়টি বলতে হলে আরও "এক্সামিন" এর ব্যাপার রয়েছে।'

তবে তিনি আসক নিশ্চিত করেছেন, আহত পুলিশ সদস্য মিনহাজ সরদার ও মো. কাওছার হোসাইন এবং সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাড়িচালক হামীম গুলিবিদ্ধ ছিলেন না।

২১ জুলাই গোপালগঞ্জের জেল সুপার তানিয়া জামান এবং কারাগারে উপস্থিত এআইজি (প্রিজন) দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম আসক প্রতিনিধিদের জানান, এ পর্যন্ত ১৮ শিশুকে আদালতের আদেশে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে ১০০ বন্দিকে পিরোজপুর এবং ৫০ জনকে বাগেরহাট কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ১৫০ বন্দির সবাই হাজতি। 

এই কারাগারে বন্দির মোট ধারণ ক্ষমতা ৩৪৮; এর মধ্যে পুরুষ ৩২১ ও নারী ২৭। ২১ জুলাই মোট বন্দি ছিলেন ৭৫১ জন।

কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৬ জুলাই আনুমানিক দুপুর ৩টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কারাগারে হামলা করে। তারা কারাগারের সীমানা প্রাচির ভেঙ্গে ফেলে, গার্ডরুম, গেস্ট ওয়েটিং রুমের ক্ষতি করে। কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। এছাড়া কারাগারের অস্ত্রভাণ্ডার ভাঙ্গার চেষ্টা করে। এই ঘটনায় কারা পুলিশ ৮০ রাউন্ড 'মিসফায়ার' করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা গোপালগঞ্জ সদর থানায় তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) আসক প্রতিনিধিদের জানান, '১৬ জুলাই সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, তা এক কথায় তীব্র। পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি, বরং সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ধারণ করেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেছে হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে এনসিপি নেতদের আমার কার্যালয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি আমার অফিসে নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করতে হয়েছিল।'

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে ৫৪ ধারাতেও আটক দেখানো হয়েছে। ২০ জুলাই পর্যন্ত মোট আটটি মামলা দায়ের হয়েছে।'

'কারাগার এবং সরকারি সম্পত্তিতে হামলার ঘটনায় এখনো মামলা দায়ের হয়নি, তবে কারা কর্তৃপক্ষ মামলা করবে,' জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Banking fix may cost $5b-$6b

Says finance adviser; the amount is way below IMF’s $35b estimate

14h ago