বম জাতিগোষ্ঠীর ৩ নাগরিকের কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি ১৫৫ নাগরিকের

স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে বম জাতিগোষ্ঠীর তিন নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ১৫৫ নাগরিক।

এছাড়া, 'সন্ত্রাস দমনের' নামে বান্দরবানে নির্বিচারে সাধারণ আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন, বিশেষত বম জাতিগোষ্ঠীর নারী-শিশু ও সাধারণ নাগরিকদের বিনা বিচারে আটক ও বছরের পর বছর কারাবন্দি রাখার কথা জানিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

পাশাপাশি এতে সব নিরপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে ভান লাল রুয়াল বম (৩৫), ৩১ মে লাল সাংময় বম (৫৫) ও ১৫ মে লাল থেলং কিম বমের (২৯) মৃত্যু হয়। অভিযোগ তোলা হয়েছে, লাল থেলং কিম বম বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই লাল থেলং কিম মারা যান। তার পরিবারের অভিযোগ, কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্য সন্দেহে লাল থেলং কিমকে ব্যাংক ডাকাতিসহ একাধিক মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাবন্দি রাখা হয়েছিল। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

ক্যানসার আক্রান্ত লাল সাংময় বম প্রাণ হারানোর আগে শেষ মুহূর্তে জামিন পেয়েছিলেন।

তার পরিবারের সদস্যদের দাবি, মিথ্যা মামলায় দুই বছর বিনা বিচারে কারাভোগ করেন ক্যানসার আক্রান্ত এই ব্যক্তি। তার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হওয়ায় প্রায় দুই মাস তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

লাল থেলং কিমের মৃত্যুর সময় কারাসূত্র জানায়, লাল সাংময় মৃত্যুশয্যায় আছেন। তার শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। সে সময় মৃত্যু নিশ্চিত জেনে দায় এড়াতে গত ২৯ মে তড়িঘড়ি করে তাকে জামিন দেওয়া হয়। কারাগারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৩১ মে হাসপাতাল থেকে ছাড়াপত্র পেয়ে গ্রামে ফেরার পথে তার মৃত্যু হয়, উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।

এতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, লাল সাংময় বমকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন লাল পেক সাং তার সঙ্গেই ছিলেন। পরবর্তীতে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে ভান লাল রুয়াল বমের মৃত্যু হয়। অভিযোগ করা হয়েছে, তিনিও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ভান লাল রুয়ালের মৃত্যু হয়েছিল।

কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৬ জুলাই রাত ১২টার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কারাগারেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাত ১টার পর চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা কদরেন।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবারগুলোর অভিযোগ তারা কেউই কেএনএফ সংশ্লিষ্ট বা অপরাধী ছিলেন না। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এর ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো চার্জশিট দেয়নি পুলিশ। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন অপরাধীরও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

শিউলী বম গ্রেপ্তার হয়ে ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি আছেন। তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বান্দরবানের নিম্ন আদালতে তিনি জামিন পাননি। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাই উচ্চ আদালতে শিউলীসহ ১১ নারীর আবেদনের ওপর শুনানি হলেও জামিন মেলেনি। সম্প্রতি উচ্চ আদালত চার নিরপরাধ নারীর জামিন মঞ্জুর করলেও, পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।

'আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, শুধুমাত্র সন্দেহবশত অপরাধী হিসেবে বছরের পর বছর রাষ্ট্রের নাগরিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না।'

২০২৪ সালে বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির জের ধরে যৌথ অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু হয়েছে, যা জাতিগত নিধনের শামিল।

'আমরা মনে করি, কিছু "কেএনএফ সদস্যদের কর্মকাণ্ড ও অপরাধ দমনের" নামে নির্বিচারে গ্রামবাসীকে আটক ও একাধিক মিথ্যা মামলায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা ও নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি,' উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিৃবতিতে পাঁচটি দাবি জানানো হয়েছে। সেগুলো হলো:

চট্টগ্রাম কারাগারে লাল থেলং কিম বম, লাল সাংময় বম ও ভান লাল রুয়াল বমের মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের জবাবদিহিতা ও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে; অবিলম্বে নিরপরাধ সব বম নাগরিকের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে; পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা, হাটবাজারে পণ্য কেনা-বেচা, জুম চাষ ও ব্যবসায়িক কাজের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি-নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে; সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনায় কেএনএফসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শনাক্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে কেএনএফ ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে জাতিগত নিধন অভিযান চিরতরে বন্ধ করতে হবে এবং সর্বশেষ বম জাতিগোষ্ঠীকে 'কালেক্টিভ পানিশমেন্ট' দেওয়ার কৌশল প্রত্যাহার এবং নির্বিচারে কারাবন্দি আদিবাসী বম বাসিন্দাদের মুক্তির পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলের সব আদিবাসীর সমান অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, একের পর এক পাহাড়ি আদিবাসীদের ওপর সংঘটিত অপ্রীতিকর ঘটনায় রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও নীরবতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিবৃতিতে যারা সংহতি জানিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, অর্থনীতিবিদ ও সর্বজন কথার সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আসকের চেয়ারপারসন জেড. আই খান পান্না, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন পারভীন হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, আলোকচিত্রী, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ড. শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং রিসার্স ফেলো ড. স্বপন আদনান, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, বম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের রুমা উপজেলার সাবেক সভাপতি লাল লিম বম, রুমা শাখা কমিটির সাবেক সম্পাদক নিলিয়ান বম, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রবেন বম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রগতি চাকমা।

Comments

The Daily Star  | English

External balance swings to surplus after 3yrs

The country’s balance of payments returned to a surplus in the fiscal year (FY) 2024-25, ending a three-year spell of deficits.

11h ago