উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ‘সীমাহীন দুর্নীতির’ সঙ্গে জড়িত: দাবি সাবেক সচিবের

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার।
তিনি এক বা দুইটি মন্ত্রণালয়ের ইঙ্গিত দিলেও নির্দিষ্ট করে কোনো নাম উল্লেখ করেননি। তবে তার দাবির পক্ষে প্রমাণ আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে 'বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)' আয়োজিত এক সেমিনারে অতিথি বক্তা হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন।
বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
বক্তব্যের শুরুতেই তিনি প্রশাসন ক্যাডারের দুর্নীতি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, 'আমাদের (আমলাদের) চরিত্র খারাপ হয়েই গেছে। কিন্তু যারা গণআন্দোলন করে আজকে চেয়ারে বসেছেন, অন্তত আট জন উপদেষ্টার আমি তথ্য প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারব, তারা সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।'
'কন্ট্রাক্ট ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হবে না, কোনো বদলি হবে না— এগুলোর প্রমাণ আছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তথ্য আছে,' বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'যে উপদেষ্টাদের দুর্নীতি প্রমাণ হয়েছে, যে উপদেষ্টার পারসোনাল অফিসারের অ্যাকাউন্টে ৪০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে, যে উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে, তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?'
যদিও কোনো উপদেষ্টার নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
এ সময় আব্দুস সাত্তার প্রশ্ন রাখেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একজন অনভিজ্ঞকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'ড. ইউনূস জানেন সেখানে কী হচ্ছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।'
এক বছরে এই সরকার কিছু ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে উল্লেখ করে সাত্তার বলেন, 'অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, ফ্যাসিস্টদের বিচার হচ্ছে, জুলাই ঘোষণাপত্র হয়েছে, জুলাই সনদ শিগগিরই হবে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এই সরকারের বড় সাফল্য বলে মনে করি।'
তিনি বলেন, 'বিগত সরকারের সময় বিতর্কিত নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছে তাদের কেউ জেলে আছে, কেউ কেউ পালিয়েছে, ওএসডি হয়েছে বা চাকরিচ্যুত হয়েছে, এখান থেকে প্রশাসন ক্যাডার অফিসারদের শিক্ষা নিতে হবে।'
দুর্নীতির বিষয়ে আব্দুস সাত্তার বলেন, 'আমরা দুর্নীতি কমাতে পারি নাই। গতকাল আমি দুটি অভিযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে এসিল্যান্ড একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমির মিউটেশন করার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন। আরেকজন ইউএনও, যিনি ঢাকার আশপাশেই কর্মরত, একটি কারখানার লে আউট প্ল্যান পাস করাতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন।'
আব্দুস সাত্তার বলেন, 'আমরা (আমলারা) কীভাবে মানুষকে জবাবদিহি করব? কীভাবে মুখ দেখাব? সবকিছুর একটা সীমা থাকা দরকার।'
তিনি বলেন, 'প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে যে সমস্ত প্রশ্ন উঠছে সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে আপনাদের অবস্থা বিপন্ন হতে বাধ্য।'
প্রশাসনে দলবাজির প্রসঙ্গ তুলে আব্দুস সাত্তার বলেন, অফিসার্স ক্লাব ছাড়াও আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ওই অফিসে শত শত, হাজার হাজার কর্মকর্তাদের যাতায়াত শুরু হয়। এক সময়ে আমার বস, তারেক রহমান আমার কাছে জানতে চাইলেন, এরা কারা, কী চায়, কী জন্য এখানে আসে?'
'আপনাদের (কর্মকর্তাদের) জন্য আমার মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। আমি বলেছি আপনারা বঞ্চিত, প্রতিকার চাইতে আসেন। উনি আমাকে বলেছেন, ইন সার্ভিস কর্মচারীদের দলীয় অফিসে আসা ভালো লক্ষণ নয়, আপনি তাদের নিষেধ করে দেন। এরপর আমি পার্টি অফিসের গেইটে নোটিশ টানিয়ে ইন সার্ভিস কর্মচারীদের দলীয় অফিসে আসতে নিষেধ করি। তাদের অফিসার্স ক্লাবে দেখা করতে বলি।'
সাবেক এই সচিব বলেন, 'দলবাজি এবং দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে, না হয় আপনাদের (প্রশাসন ক্যাডারের) কপালে দুঃখ আছে। ডিসি, ইউএনও বা এসিল্যান্ড তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না। অনেক জায়গায় বেইজ্জতি হবেন।'
'এত টাকা-পয়সা কোথায় রাখবেন? আমরা কিন্তু টাকা পয়সা বের করার পথ পেয়ে গেছি। গত সরকারের আমলে দেশ-বিদেশের যে যাই করেছেন কোনো কিছুই গোপন থাকছে না,' বলেন তিনি।
'গত ১৫ বছরের দুর্নীতির রেশিওতে গত এক বছরে ছাড়িয়ে যাওয়ার অপবাদ আছে, এর চেয়ে বড় লজ্জা আমাদের কী হতে পারে,' উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই গণঅভ্যুত্থানের পর যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদেরকে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। আপনারা হিসেব করে দুর্নীতি করবেন, এতে আপনার পরিবার, ব্যক্তিজীবন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।'
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর নিয়াজ আহমেদ খান।
অনুষ্ঠানে জুলাইয়ে শহীদ হওয়া চার পরিবারের চার জন আমন্ত্রিত প্রতিনিধি প্রশাসনের কাছে তাদের প্রত্যাশার কথা জানান।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. সৈয়দা লাসনা কবীর, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব জনাব কানিজ মওলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. শাফিউল ইসলাম।
Comments