প্রাচুর্যের তিস্তা এখন প্রায় শূন্য, পেশা ছেড়েছেন হাজারো জেলে

একসময় মাছের প্রাচুর্যে ভরা তিস্তা নদী এখন প্রায় শূন্য। এতে নদীপাড়ের হাজারো জেলে পরিবারে চলছে টিকে থাকার লড়াই। দুই দশক আগেও যেখানে রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড়, পাবদা, চিংড়ি আর ঐতিহ্যবাহী বৈরালি মাছে জেলেদের নৌকা ভরে যেত, এখন সেখানে দিনে এক কেজি মাছ পাওয়াও কঠিন।
বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী উত্তরের পাঁচ জেলা – লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ১৩টি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তাপাড়ে ৩২টি জেলেপাড়া রয়েছে। প্রতিটি জেলেপাড়ায় ১০০-২৫০টি পরিবার বসবাস করে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালেও তিস্তায় প্রায় ১৭ হাজার জেলে মাছ ধরতেন। সেই সংখ্যা এখন দুই হাজারে নেমে এসেছে। যারা এখনো পেশা ছাড়েননি, তাদের আয় কমেছে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৬৫ বছর বয়সী জেলে সুধাচরণ দাসের কথায় ফুটে ওঠে স্মৃতি আর আক্ষেপ। তিনি বলেন, 'নব্বইয়ের দশকে কয়েক ঘণ্টা জাল ফেললেই নৌকা ভরে যেত। ২০-৩০ কেজি মাছ ছাড়া বাড়ি ফিরতাম না। এখন দিনে এক কেজিও পাই না।'
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ বছর আগেও তিস্তা নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল, বড় আকৃতির বোয়াল, টেংরা, আইড়, গোঁস, শোল, গজার, পাবদা, চিংড়ি, চাঁদা, পুঁটি, মলা, ঢেঁকী, টাকি, ডারকিনা, চিতলসহ আরও বিভিন্ন জাতের মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ত। এসবের সঙ্গে পাওয়া যেত তিস্তার ঐতিহ্যবাহী বৈরালি মাছ।
মাছের এই সংকটের কারণে বহু জেলে বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। লালমনিরহাটের বিনোদ চন্দ্র দাস (৫৫) মাছ ধরা ছেড়ে এখন অটোরিকশা চালান। তিনি বলেন, 'বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আমার মতো অনেকেই এখন নিরুপায়।' কুড়িগ্রামের কমলাকান্ত দাসের ভাষ্য, 'জাল আর নৌকা মেরামত করতেই যা খরচ হয়, মাছ বেচে সেই টাকা ওঠে না। প্রতি বছর ঋণ করতে হয়।'
একই গ্রামের জেলে নবীন দাসের স্ত্রী সুলেখা দাস বলেন, 'এখন মাছ ধরা মানেই পেটে খাবার না জোটা। আগে প্রতিদিন মাছ খেতাম, এখন সপ্তাহে একদিনও জোটে না।'
তিস্তার জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মূলে রয়েছে পানির প্রবাহ সংকট। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের কারণে শুকনো মৌসুমে তিস্তা প্রায় শুকিয়ে যায়। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের মতো মারাত্মক সমস্যা। হঠাৎ বন্যা এবং চর পড়ে নদীর সঙ্গে খাল-বিলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মাছের ডিম পাড়ার জায়গা নষ্ট হয়েছে। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে কারেন্ট জালের ব্যবহার ও পোনা ধরার মতো ধ্বংসাত্মক কাজ।
সব মিলিয়ে কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নদীর পরিবেশকে মাছের জন্য প্রায় বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা নিলে তিস্তায় আবারও মাছ ফেরানো সম্ভব। তিনি অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ, অভয়ারণ্য তৈরি, প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন। তবে তার মতে, সবচেয়ে জরুরি হলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার ন্যূনতম পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিত করার চুক্তি।
একই সুরে কথা বলেন রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আয়না হক। তিনি বলেন, 'শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত প্রবাহ ছাড়া কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। তিস্তাকে তার মতো চলতে দিতে হবে।' তিনি আরও বলেন, তিস্তায় মাছ বাড়াতে কিছু প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর পর্যালোচনা চলছে।
Comments