মব ভিকটিম প্রদীপের ঘর এখন অন্ধকার

নিহত প্রদীপের পরিবার। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

রংপুরের তারাগঞ্জে মব সন্ত্রাসের ভিকটিম প্রদীপ লাল রবিদাসের (৪৭) পরিবারে এখন আর প্রদীপ জ্বলছে না। অন্ধকার ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে তার স্ত্রী-সন্তানরা। চিরদিনের জন্য প্রদীপ নিভে গেছে এই পরিবারের।

নিহতের মেয়ে, এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী পলাশী রবিদাস (১৬) কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, 'আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। বাবা নেই। তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরেছে মব সন্ত্রাসীরা। বাবা ছিলেন সংসারের একমাত্র ভরসা। এখন তো একমুঠো ভাতের জন্যও আমাদের কষ্ট করতে হচ্ছে।'

প্রদীপের বড় ছেলে দুলাল রবিদাস (১৯) ২০২২ সালে এসএসসি পাস করলেও দারিদ্র্যের কারণে কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। সংসারের হাল ধরতে তিনি দিনমজুরির কাজে নেমেছেন। ছোট ছেলে আপন রবিদাস (১৩) সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম খামার মকিমপুরে প্রদীপ লাল রবিদাসের বাড়ি। এই গ্রামে একসঙ্গে ছয়টি রবিদাস ও সাতটি সাঁওতাল পরিবারের বসবাস। গ্রামের অন্য পরিবারগুলোর নিজস্ব বসতভিটা থাকলেও প্রদীপের পরিবারকে থাকতে হচ্ছে অন্যের জমিতে। ভাঙাচোরা দুটি টিনের ঘরই তাদের একমাত্র আশ্রয়। প্রদীপ আগে ফুটপাতে জুতা সেলাই করতেন। ছয় বছর আগে অসুস্থ হয়ে পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলতে হয়েছিল। পরে জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীর সহায়তায় একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান পান। সেটি চালিয়েই কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছিলেন।

পলাশী বলেন, 'বাবা প্রতিবন্ধী হয়েও ভ্যান চালিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ দিতেন। তিনি চাইতেন আমরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হই। কিন্তু সেই স্বপ্নটা কেড়ে নিল তারাগঞ্জের মব সন্ত্রাসীরা।' ছোট ছেলে আপন চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, 'পড়াশোনা হয়তো আর হবে না। বাবার পথ ধরে আমাকেও জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হবে। ক্ষুধা তো আর বই পড়ে মেটে না।' দিনমজুরি করে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয় বড় ছেলে দুলালের। কিন্তু এত অল্প আয়ে সংসার চলে না। তিনি বলেন, 'বাবা যে ভ্যানটা চালাতেন, সেটা এখন পুলিশের কাছে। ওটা ফিরে পেলে হয়তো উপার্জন বাড়ত। ভাই-বোন পড়াশুনা করতে চায় কিন্তু এখন আমি একা কিছুই করতে পারছি না।'

প্রদীপের স্ত্রী দুলালী রানী রবিদাস (৪২) বলেন, 'অন্যের জমিতে থাকি। ঘরটাও ভাঙা। স্বামী কষ্ট করে হলেও প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা উপার্জন করতেন। সেই মানুষটাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ওরা। আমাদের অন্নদাতাকে কেড়ে নিয়েছে। আমি বিধবা, আমার সন্তানরা এতিম।' প্রদীপ ও রূপলালকে যেদিন ভ্যানচোর সন্দেহে মব সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে, সেদিনের কথা স্মৃতিচারণ করেন দুলালী রানী। তিনি বলেন, '৯ আগস্ট দুপুরে বাড়ির পাশে চৌধুরী গোপাল বাজার থেকে দুই কেজি খুড়মা ও দেড় কেজি ড্রাগন ফল কিনেছিলেন আমার স্বামী। এসব নিয়ে তিনি আমার মামা রূপলালের বাড়ি যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেদিন রাতেই ওদের দুজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে ওরা।'

প্রতিবেশী সুবল সরেন (৪৮) বললেন, 'প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা একসাথে মন্দিরে বসতাম। প্রদীপ সবসময় সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত থাকত। সে সৎ মানুষ ছিল। কষ্টের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে চাইত।' গ্রামের প্রবীণ স্কুলশিক্ষক জিতেন চন্দ্র আচার্য্য (৮৪) বলেন, 'প্রদীপের পরিবার আমার জমিতে থাকে। চরম দারিদ্র্যেও প্রদীপ ছিল সৎ, পরিশ্রমী মানুষ। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশই গরীব হওয়ায় পরিবারটিকে সহায়তা করার মতো সামর্থ্য কারো নেই।'

গত ৯ আগস্ট রাতে তারাগঞ্জ উপজেলার বুড়িরহাট বটতলায় ভ্যানচোর সন্দেহে প্রদীপ লাল রবিদাস ও তার মামা শ্বশুর রূপলাল রবিদাসকে আটক করে স্থানীয় কয়েকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে মব তৈরি করা হয়। প্রদীপ ও রূপলালকে যখন পেটানো হচ্ছিল তখন সেখানে পুলিশ এসেছিল। কিন্তু 'মবের ভয়ে' তাদের উদ্ধার না করে ফিরে যায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান; অন্যজন মারা যান কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

Comments

The Daily Star  | English

Remittance rose 9% in August

However, August’s inflow was 2.22 percent lower than the previous month

1h ago