আরো ৩০ বাংলাদেশিকে হাতকড়া-শিকল পরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

হাতে হাতকড়া ও পায়ে শিকল পরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে তাদের বহনকারী বিশেষ ভাড়া করা উড়োজাহাজটি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মুখপাত্র ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৩০ বাংলাদেশি নাগরিককে নিয়ে আসা চার্টার্ড ফ্লাইটটি বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় অবতরণ করে।

ওয়াশিংটন যাদের ফেরত পাঠিয়েছে, তাদের মধ্যে এক নারীও আছেন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উড়োজাহাজটি অবতরণের পর তিন ঘণ্টা রানওয়েতে ছিল।

ওই তিন ঘণ্টায় উড়োজাহাজের যাত্রীদের হাতকড়া ও শিকল খোলা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও বিমানবন্দরের সূত্ররা জানান, উড়োজাহাজ থেকে বের হয়ে আসার পর রানওয়ে পর্যন্ত শিকল বেধেই তাদের নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দরের এরাইভাল লাউঞ্জে পৌঁছানোর আগেই সবাইকে শিকলমুক্ত করে দেয়া হয়। এ সময় কাউকে তাদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি।

পরবর্তীতে রাত ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের বিমানবন্দরের ভেতর আনা হয়। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ টিম, কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ টিম ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা ছবি তোলার চেষ্টা করলে তারা বাধার মুখে পড়েন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দীর্ঘ যাত্রা ও শিকল পরে থাকার কারণে আগতরা ছিলেন বিধ্বস্ত।

এ সময় নোয়াখালীর ২২ বছর বয়সী তরুণ আব্দুল্লাহ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'এই লম্বা যাত্রায় পুরোটা সময় হাতে পায়ে দাগী আসামীদের মতো শিকল পরিয়ে রেখেছিলো। একে তো দেশে ফেরত আসার হতাশা! তার ওপর টেরোরিস্টের (সন্ত্রাসী) মতো হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে আসার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কারো যেন না হোক, এই কামনা করি।'

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক মাসে অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আসার তথ্য জানা গেছে।

প্রথম দিকে হাতকড়া ও শিকল না পরানো হলেও ২ আগস্ট একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭ করে এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। তাদের সবার হাতকড়া ও শিকল ছিল। গতকালও সবার হাতে হাতকড়া ও শিকল ছিল।

ফেরত আসা ব্যক্তিরা জানান, প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রার প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত তারা হাতকড়া ও শিকলে বাধা অবস্থায় কাটিয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, তাদেরকে শুধু রুটি আর পানি খেতে দেওয়া হয়েছে।

এমন কী, টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে যেতেন, আবার শিকলে বেধে সিটে ফিরিয়ে আনতেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। 

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও বিমানবন্দরের অভিবাসন বিভাগের সূত্ররা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৮ জুন অপর একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়।

এর আগে চলতি বছরের ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক ফ্লাইটে আরো অন্তত ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত ১৮০ ছাড়িয়েছে।

মার্কিন আইন অনুযায়ী বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসন প্রত্যাশীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ (আইসিই) তাঁদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার কারণে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটের ব্যবহার বেড়েছে। বেশির ভাগ অভিবাসন প্রত্যাশী মেক্সিকো বা লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে বা অন্য কোন পন্থায় ৩০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে থাকেন।  

গতকাল ফিরে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি বড় অংশ দাবি করেন, তারা মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে মেক্সিকোর মাফিয়ার কাছে আটক হন।

অন্তত ছয় জনের দাবি, তাদেরকে জিম্মি করে, অত্যাচার করে পরিবারের কাছ থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের তানজিল হাসান জানা, তিনি সহ অনেকেই এই মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান।

তাদের কারো কাছ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে ওই চক্র।

তারা তাদের সহায়-সম্পত্তি সকল কিছু বিক্রি করে মানবপাচারকারী চক্রকে টাকা দিতে বাধ্য হন।

'এমন অগণিত বাংলাদেশী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে অপহৃত অবস্থায় আছেন, যোগ করেন তিনি।

এর আগে ২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তারাও বিশেষ ফ্লাইটে এসেছিলেন এবং তাদেরকেও যাত্রাপথে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল।

ওই দৃশ্য সে সময় দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এভাবে শিকল পরানোয় মানবাধিকার ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শিকল ব্যবহার পরানো উচিত নয়। সাধারণ অভিবাসন প্রত্যাশীদের হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী বলেও মত দেন তারা। 

অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, 'উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় পাচারের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা বা মেক্সিকো হয়ে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে লোকজনকে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। নথি ঠিক না থাকলে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Election in Bangladesh

Why are we trying to make the election uncertain?

Those who are working to prevent the election should question themselves as to how the people will be empowered without one.

15h ago