বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ওপর ‘চোরাগোপ্তা হামলা’ চলছেই

নাটোরের নলডাঙ্গা, সিংড়া ও লালপুরে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলার অভিযোগ উঠছে। সন্ত্রাসীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হেলমেট ও মাস্ক পরে হামলা চালাচ্ছে। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন করে হামলা হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সাদা মাইক্রোবাস নিয়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বাহিনী জেলাজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটছে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও।
তাদের দাবি, সর্বহারা হিসেবে পরিচিত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা বিভিন্ন সময় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
নাটোর জেলায় গত দুই মাসে এরকম আটটি হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। এর মধ্যে ছয়টি ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বলেছেন হামলাকারীরা সর্বহারা দলের সদস্য বলে তারা সন্দেহ করছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকায় তারা টার্গেট হয়েছেন।
চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনায় নাটোরে গত তিন মাসে পাঁচটি মামলা হওয়ার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে একটি ঘটনায় চরমপন্থীদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। অন্য ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
গত ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নাটোর সদর উপজেলার মাঝদীঘার মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সংগঠক সাইদুল ইসলামকে পাঁচ-ছয় জন অপরিচিত ব্যক্তি মাদ্রাসার বাইরে ডেকে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায়। তাকে পিটিয়ে একই উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামে ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা।
এর আগে ১৬ অক্টোবর নলডাঙ্গা উপজেলার বাঁশিলা গ্রামের নওশাদ নোমানী ও নাসির উদ্দিনের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে হামলা চালায় মুখোশধারী চার-পাঁচ জন। এদের মধ্যে নওশাদ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ইসলামী বক্তা এবং নাসির দলের অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত।
নাসির বলেন, ঘটনার পর থানায় অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। থানা থেকে প্রথমে অসহযোগিতা করা হলেও পরে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেওয়া হয়।
নওশাদ বলেন, 'হামলার তিন দিন পর থানায় মামলা করতে গেলে ওসি বলেন হামলার ব্যাপারে তিনি জানেন কিন্তু মামলা নেবেন না।'
জামায়াত করার কারণেই তার ওপর হামলা হয়েছে বলে মনে করেন নওশাদ।
গত ২১ অক্টোবর রাতে নাটোর সদর উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সভাপতি আবু রায়হানকে মির্জাপুর বাজার থেকে পিবিআই পরিচয়ে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। পরে তাকে কুপিয়ে রাজশাহীর পুঠিয়ায় একটি গ্রামে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
রায়হান বলেছেন, বিচার পাবেন না ভেবে মামলা করেননি তিনি। তার ধারণা, মামলা করলে আরও নির্যাতন নেমে আসবে। হামলাকারীরা সবাই তার অপরিচিত। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এসব হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
২৫ অক্টোবর নলডাঙ্গার নশরতপুর বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে জামায়াত কর্মী আলাল প্রামাণিককে মোটরসাইকেলে করে আসা হেলমেট বাহিনী পিটিয়ে আহত করে।
তিনি বলেন, হামলাকারীদের একজনকে চিনতে পেরেছেন তিনি। সম্প্রতি সর্বহারা পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
২৬ অক্টোবর রাতে নলডাঙ্গা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমানের ওপর হামলা চালায় হেলমেট বাহিনী। পরিবারের সদস্যরা জানান, ফজলুর রহমানের হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার।
ফজলুর রহমানের ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'যেখানে হামলা হয় সেখান থেকে নলডাঙ্গা থানার দূরত্ব মাত্র ৫০০ ফুট। হামলাকারীরা সেখান থেকে নলডাঙ্গা শহরের দিকে চলে যায়। হামলাকারীরা যে পথে যায় সেই পথে কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। খুব সহজেই হামলাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু পুলিশ তা করেনি। এই ঘটনায় পুলিশের যোগসাজশ এবং আসামি ধরতে অবহেলা পরিষ্কার বোঝা যায়।'
তিনি আরও বলেন, হামলার পর ফজলুর রহমানকে হাসপাতালে পাঠাতে যিনি ভ্যান ভাড়া করে দেন তিনিও চরমপন্থী দলের সাবেক সদস্য। তার অভিযোগ, আত্মসমর্পণকারী সর্বহারারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ এদের পৃষ্ঠপোষক।
৩০ অক্টোবর রাতে নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মোশারফ হোসেনকে বাড়ি থেকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নেওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। তারা জানায়, মোশারফকে রড দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলে রেখে যায় মুখোশধারীরা।
মোশারফের ছোট ভাই ইসমাইল হোসেন জানান, হামলার ঘটনায় নলডাঙ্গা থানায় জিডি করেছেন তারা।
৩ নভেম্বর রাতে লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানাকে নিজ দোকান থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে ডিবি পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে গোপালপুর মহিলা কলেজের পাশে হাত-পা বাঁধা আহত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।
১০ নভেম্বর সিংড়ার ছাতারদিঘী ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি ও করচমারিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে কালিগঞ্জ এলাকায় তার পথরোধ করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় চার-পাঁচ জন মুখোশধারী। তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বগুড়ার নন্দীগ্রামে রাস্তার ধারে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
১২ নভেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে নলডাঙ্গা উপজেলার বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের নেতা সজীব হোসেনকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে আধা কিলোমিটার দূরে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয় তাকে।
সজীব বলেন, তাকে উদ্ধারের সময় সেখানে পুলিশ থাকলেও তারা সহায়তা করেননি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর দেখেন রাজশাহী, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া থেকেও চোরাগোপ্তা হামলায় আহত বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সেখানে চিকিৎসা চলছে। তার দাবি, চরমপন্থীদের দিয়ে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
নাটোর জেলা জামায়াতের আমির মীর নূরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ জড়িত বলে মনে করেন তিনি। হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে সরকার কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে এসব করাচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা জামায়াতের আহত নেতাকর্মীদের উদ্ধার এবং সেবা করেছে তাদেরকে আবার নতুন নতুন মামলায় আসামি করা হচ্ছে।
নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের প্রশ্রয়ে চরমপন্থীরা এসব হামলা চালাচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নলডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম বলেন, গুপ্ত হামলায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। তবে এখনও কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
নাটোরে চোরাগোপ্তা হামলার প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২৩ সেপ্টেম্বর নলডাঙ্গার পিপরুল ইউনিয়নের বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ওপর। হামলাকারীদের মধ্যে জাকির এবং রেজাউলকে চিনতে পারেন তিনি। পরের দিন তার ছোটভাই জসিম উদ্দিন এই দুজনসহ মোট চার জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন।
নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, নাটোর জেলায় আটটি চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে পাঁচটি ঘটনায় মামলা হয়েছে, তিনটিতে এখনও মামলা হয়নি। তবে এসব ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
সর্বহারাদের জড়িত থাকার বিষয় জানতে চাইলে এসপি বলেন, নলডাঙ্গার জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ঘটনায় রেজাউল নামে একজন আত্মসমর্পণকারী সর্বহারার জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। পরবর্তী গুপ্ত হামলার ঘটনাগুলোতে হামলাকারীদের পরিচয় মামলায় উল্লেখ করা হয়নি। আত্মসমর্পণকারী সর্বহারাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি সহায়তা এবং দেখাশোনা করেন পুলিশ। গুপ্ত হামলায় ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকা বা হামলাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ সত্য নয়।
Comments