খালেদা জিয়ার সাজা দীর্ঘায়িত করতে সরকার সাজা স্থগিতের চালাকি করছে: ফখরুল

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর | স্টার ফাইল ফটো

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা দীর্ঘায়িত করতেই সরকার সাজা স্থগিতের 'চালাকি'র আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি এই অভিযোগ করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'আপনারা জানেন যে, খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছরের বেশি জীর্ণ-পরিত্যক্ত কারাগারে ছিলেন… তারপরে নিয়ে আসা হয়েছে পিজি হাসপাতালে, সেখানে তিনি কোনো চিকিৎসা পাননি… শেষে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে সাজা স্থগিত করে। এখানে আরেকটা চালাকি আছে… চালাকিটা কী? যেমন আমি বলি না, ছয় মাস ছয় মাস করে সাজা স্থগিত করছে, তার মানে সাজা কিন্তু কমছে না। সেই সাজা আবার গুণতে হবে ভবিষ্যতে যখন তাদের প্রয়োজন হবে… এটা হচ্ছে আরেকটা চালাকি। অর্থাৎ আরও বেশি দীর্ঘায়িত করা হবে।'

'আপনারা জানেন যে, লোয়ার কোর্ট তাকে পাঁচ বছর সাজা দিয়েছিল, কিন্তু হায়ার কোর্ট সেই সাজা ১০ বছর করেছে। আপনারা জানেন যে, মামলাগুলো সাজানো ছিল, মিথ্যা মামলা ছিল, সেভাবে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যটা ছিল, তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাকে সরিয়ে দেওয়া মানে এদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সরিয়ে, উন্নয়নের পক্ষের শক্তিকে সরিয়ে দেওয়া। এটা ছোটখাটো ব্যাপার নয়, এটা হচ্ছে একটা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপার।'

তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে আমরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদের আন্দোলন করেছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, ব্যাংক লুটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, আমরা পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য যে আন্দোলন করছি, সেটা সম্পূর্ণভাবে সামগ্রিক আন্দোলনের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা আন্দোলন। কেন? দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর গণতন্ত্র এক-অভিন্ন… একে আলাদা করা যাবে না। যদি দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে পারি, আমরা গণতন্ত্রকেও মুক্ত করতে পারব। আসুন আমরা দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই এবং দেশনেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে যে অন্যায়ভাবে আটক করে রাখা হয়েছে, তার মুক্তি চেয়ে সবাই কথা বলুন, সোচ্চার হোন, আন্দোলনে শরিক হোন।'

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের উদ্যোগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এই মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনের সড়কের এক পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার ছবি-সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করে এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, 'বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আপনারা দেখেছেন, যেসব চুক্তি করা হয়েছে, সমঝোতা করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের পক্ষে নয়। যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে, তিনি আবার আমাদেরকে সবক দেন। সবক কী রকম? আমরা নাকি চুক্তি আর সমঝোতার মধ্যে পার্থক্য বুঝি না। আমাদেরকে উনি পড়াশোনা করার জন্য পরামর্শ দেন... আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, দেশের সঙ্গে বিদ্রোহ করবেন না, বেঈমানি করবেন না। মানুষকে বোকা বানিয়ে, তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে এমন চুক্তি করার সাহস করবেন না, এমন কোনো সমঝোতা স্মারক সই করবেন না যেটা আমার দেশের আমার জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে।'

'কী এনেছেন এবার ভারত সফরে গিয়ে? তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি করতে পারেননি। কী করেছেন? তিস্তা প্রকল্পের জন্য ভারত প্রস্তাব দিয়েছে, চীনও দিয়েছে। শেখ হাসিনা বলেছেন যে, আমরা দুইটার মধ্যে দেখব কোনটা ভালো হয়। আবার সব শেষে এ কথা বলেছেন, ভারত যে প্রস্তাব দিয়েছে তাদেরকে যদি আমরা কাজটা দেই, তাহলে আমাদের পানির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা সব বোকা মানুষগুলো এদেশে বাস করি? আপনি তিস্তার পানি যে সমস্যা সেটাকে আপনি বাতিল করে দিলেন, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের সমস্যার সমাধান আর হলো না, সমস্যাই রয়ে গেল। এবার আপনারা একটা দেশকে ভারতের কাছে পুরোপুরি জিম্মি করে দিচ্ছেন।'

ফখরুল বলেন, 'অথচ সীমান্তে হত্যা হচ্ছে প্রতিদিন, গতকালও হত্যা হয়েছে। এ বিষয়ে একটা কথা আপনি এই সফরে বলেছেন? আমাদের সরাসরি প্রশ্ন আপনাদের কাছে যে, পৃথিবীর কোন বন্ধু দেশ আছে… আপনারা এত বন্ধুত্ব যে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধুত্ব আপনারা বলেন… তাহলে কোন বন্ধু দেশ আছে তার সীমান্তে বন্ধুরা গুলি করে হত্যা করে তার বন্ধুদেশের মানুষকে। এর জবাব আপনাদের দিতে হবে। আপনারা অনেক কথা বলেছেন। আমি বলি, আপনারা আত্মরক্ষার জন্য যেসব কথা বলেছেন, এসব কথা বলে জনগণকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।'

কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, 'কেন আমাদের নেত্রী আইনি সহায়তা পাচ্ছে না। সবাই জামিন পায়, খালেদা জিয়া পায় না। আজকে আইনি প্রক্রিয়াকেও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বাধাগ্রস্ত করেছেন। তিনি ৪০২ ধারা নিজের হাতে নিয়ে শর্তসাপেক্ষে বন্দি অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়াকে বাসভবনে রেখেছেন।'

'আমরা বলতে চাই, কারো করুণা-কৃপা আমরা চাই না। আমরা আমাদের অধিকার জনগণকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করবই। আমরা বলতে চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি মানেই জনগণের মুক্তি, খালেদা জিয়ার মুক্তি মানে গণতন্ত্রের মুক্তি, এই কথাটা সত্য। এই সত্য উপলব্ধি করে এই চেতনায় রাজপথে আমরা নামব। জেল আর মৃত্যু এটা আমাদের জন্য অবধারিত। তাই আর কাউকে ছাড় দেবো না। লড়াই আমরা করব, লড়াইয়ে বাধা আসলে সেই বাধা অতিক্রম করব। আমরা আর চুপ করে ঘরে বসে থেকে মার খেতে রাজি না।'

খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন শুধু ঢাকার নয়াপল্টন নয়, সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান তিনি।

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, 'আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যে হসপিটাল ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) অ্যাম্বুলেন্স দিতে অস্বীকার করেছে, সেই হাসপাতালের আমি একজন পরিচালক। তবে পরিচালক আমি আরেকটা কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে, এই ধরনের একটা গর্হিত কাজ, একটা মানবিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে এটা কীভাবে সম্ভব? আমি কথা দিতে পারি যে, আগামী বোর্ড মিটিংয়ে আমি এটা খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করব এবং আমি ম্যানেজমেন্টের কাছে একটা জবাবদিহি চাইব। জবাবদিহিতার তো কিছু নাই, আমি এটা প্রোটেস্ট করব।'

'তবে আমরা যদি অন্যদিকে যাই, বাংলাদেশের আজকাল প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক, সেটা হসপিটাল হোক যেকোনো প্রতিষ্ঠান ধরেন…. একদম বাংলাদেশের পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) সব কিছুই এই সরকার কবজায় নিয়ে গেছে। যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত, মানুষের টাকায় পরিচালিত সেগুলো এখন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। অতএব এ থেকে মুক্তি পেতে হলে, আমাদের নেত্রীকে মুক্তি করতে হলে একটাই রাস্তায় খোলা আছে… সেটা হলো রাজপথে নেমে এই স্বৈরাচারি সরকারকে এই অনির্বাচিত সরকারকে এ অবৈধ সরকারকে উৎখাত করা।'

শুক্রবার রাত ২টায় গুলশানের ফিরোজায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া 'হঠাৎ অসুস্থ' হয়ে পড়লে তার জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে পাননি বলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে শনিবার জানিয়েছিলেন। পরে এভার কেয়ার হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে দ্রুত সেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরদিন তার হৃদযন্ত্রে 'পেসমেকার' বসানো হয়।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের আহ্বায়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, 'সারাদেশে দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে। খালেদা জিয়া আজকে মৃত্যু শয্যায়। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন আপসহীন নেত্রী যিনি বলেছিলেন এদেশের জনগণ আমার সন্তান, আমি মরলে এ দেশেই মরব। যিনি মিথ্যা মামলায় কারাগারে জর্জরিত। যাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।'

'দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে আজ আমাদের আর স্লোগানে আটকে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে রাস্তায় নামতে হবে সবাইকে যার যার জায়গায় থেকে। আজকে দেশনেত্রীকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলুন। এতে অবশ্যই যে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশকে অন্য দেশের দাসে পরিণত করতে চলেছে, সেই সরকারের পতন ঘটিয়ে আমার দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হবে এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।'

নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক সেলিমা রহমানের সভাপতিত্বে ও সচিব নিপুণ রায় চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, শিরিন সুলতানা, রফিকুল ইসলাম, মীর নেওয়াজ আলী, আমিরুল ইসলাম খান আলীম, শফিকুল ইসলাম মিল্টন, ফরিদা ইয়াসমিন, যুব দলের গোলাম মাওলা শাহিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago