এরফুর্ট ল্যাট্রিন ডিজাস্টার: মলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন বহু অভিজাত জার্মান
জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর এরফুর্ট। অষ্টম শতাব্দী থেকেই এখানে গড়ে উঠতে থাকে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। সে সময়ের নগর সভ্যতার যে উপাদানগুলো এখনো অবশিষ্ট আছে তার একটি হলো সেন্ট পিটারের গির্জা। এই গির্জাতেই ১১৮৪ সালের ২৬ জুলাই ঘটে গিয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক ও অদ্ভুত একটি ঘটনা। যা 'এরফুর্ট ল্যাট্রিন ডিজাস্টার' নামে পরিচিত।
সামন্তপ্রভু ও পুরোহিতদের দ্বন্দ্ব
জার্মানির সিংহাসনে তখন হেইনরিখ সিক্স বা ষষ্ঠ হেনরি। তিনি ছিলেন হোহেনস্টাউফেন বংশের সম্রাট। সে সময়ের জার্মানির শাসনব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক, অর্থাৎ রাজা তার অমাত্য-পারিষদবর্গ ও ভূস্বামী- জমিদারদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতেন।
এখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ভূমিকা ছিল পুরোহিতদের। তারা রাজপরিবারের আস্থাভাজন ছিলেন। জনসাধারণের ওপর তাদের ছিলো ব্যাপক প্রভাব।
সে সময় দুজন ভূস্বামীর ভেতর শুরু হয় ভূমি দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব। এদের একজন প্রথম কনরাড, যিনি ছিলেন মেইনজের আর্চবিশপ। ওই অঞ্চলে তার কাজ ছিল আজকের দিনের জেলাপ্রশাসকদের মতো। আরেকজন ছিলেন তৃতীয় লুডউইগ, যিনি থুরিনজিয়া নামে একটি অঞ্চলের ভূস্বামী ছিলেন। মূলত মেইনজের একটি জায়গার দখল নিয়েই তাদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এখানে স্থানীয় পাদ্রীরা লুডউইগ ও কনরাডের পক্ষে ভাগ হয়ে জনগণকে কাছে টানার চেষ্টা করতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সম্রাট কর্তৃক সমঝোতা বৈঠক আহ্বান
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির নিরসনে শেষপর্যন্ত সম্রাট ষষ্ঠ হেনরি হস্তক্ষেপ করেন। উভয়পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবার লক্ষ্যে তিনি সেন্ট পিটার গির্জায় তাদের সমবেত হতে বলেন।
অবশেষে ১১৮৪ সালের ২৬ জুলাই উভয়পক্ষই তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে গির্জায় সমবেত হন।
আলোচনা চলতে থাকে গির্জার একটি ফ্লোরে। তবে ঠিক কোন ফ্লোরে তা ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত হতে পারেননি। একপর্যায়ে রাজা ষষ্ঠ হেনরি প্রশাসনিক কিছু বিষয়ে আলোচনার জন্য সাময়িক বিরতি নিয়ে কক্ষের বাইরের ফাঁকা করিডোরে আর্চবিশপ প্রথম কনরাডকে ডেকে নিয়ে যান।
এর কিছুক্ষণ পরই এক বিকট শব্দ। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রায় সবাই নিচে পড়ে যান। অধ্যধিক জনসংখ্যার চাপ সামলাতে না পেরে ফ্লোর ভেঙে পড়ে।
ফ্লোর ভেঙে সোজা মলের স্তুপে
সে সময়ের ইউরোপে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত ছিল না। কোন প্রাসাদ বা বড় অট্টালিকার দেয়ালের বাইরের দিক দিয়ে ড্রেনেজ লাইন থাকতো। সাধারণত মলত্যাগের জন্য বিরাট চৌবাচ্চার আকৃতির শৌচাগার তৈরি করা হতো। মাঝের বড় গর্ত দিয়ে মল চলে গিয়ে দেয়ালের বাইরের ড্রেনেজ গর্তে স্তুপ হতো।
বৈঠকে উপস্থিতদের দুর্ভাগ্য, সেন্ট পিটারস গির্জার এই মলাগার ছিল ঠিক ওই ফ্লোরের নিচেই। তাই ফ্লোরের মেঝের কাঠ ভেঙে পড়ে সবাই তলিয়ে যান মলের ভেতর।
সম্রাট ষষ্ঠ হেনরি ও আর্চবিশপ প্রথম কনরাড জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ভূস্বামী তৃতীয় লুডউইগও আকস্মিকভাবে বেঁচে যান। তবে এই ঘটনায় ষাট জনের বেশি অভিজাতের মৃত্যু হয়। কারও কারও মতে, সংখ্যাটি ছিলো একশর কাছাকাছি।
মৃতদের ভেতর ছিলেন- হেইনরিখ ফন সোয়ারবেগ, হেসে গোজমার ফন যেইজেনহার্স, ফ্রেইডরিখ ফন আবেনবার্গ, ফ্রেইডরিখ ফন কিরেনবার্গ, বুরকার্ড ফন ওয়ার্থবার্গ, বেরিঞ্জার ফন মিলেনজেন প্রমুখ।
করুণ মৃত্যু
এমন মৃত্যুর ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। তাদের মৃত্যু কি উপর থেকে পড়ে যাবার ফলেই হয়েছিল? নাকি মলের স্তুপে অধিক মানুষ বাতাদের অভাবে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন?
গবেষক পাস্তোর লুডেইজমেন এর মতে, এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যাপারটি ঘটেছিল। দূরত্ব অতবেশি ছিলো না যে, কেউ পড়ে আঘাত পেয়ে মারা যাবে। কিন্তু মলের স্তুপে পড়ায় তাদের শ্বাসগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই মারা যান।
পরবর্তীতে অবশ্য সেই দ্বন্দ্ব মিটেছিল কিনা তা পরিষ্কারভাবে জানা যায় না। এরপর এ নিয়ে আর কোনো সভা আহ্বানও করা হয় না। লুডউইগ বলতে গেলে একরকম নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে আসেন। জানালার গ্রিল ধরে ঝুলতে থাকা সম্রাট ষষ্ঠ হেনরি ও আর্চবিশপ প্রথম কনরাডকে নিরাপত্তারক্ষীরা উদ্ধার করেন।
এরপর সেই জায়গা নিয়ে আর কেউই নিজস্ব দাবি জানাননি। তাই সেই দ্বন্দ্বও শেষ হয়ে যায় এ ঘটনার সঙ্গে।
Comments