মৃত মানুষের বিয়ে দেওয়া হয় যেখানে

মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্য পৃথিবীতে আর নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও মৃত্যু নিয়ে আসে কিছু আনুষ্ঠানিকতাও। ধর্মের ভিত্তিতে ব্যক্তির পৃথিবী থেকে চিরবিদায় হয় কখনো জানাজার মাধ্যমে, কখনো দাহ বা শেষকৃত্যের মাধ্যমে।
বিয়ের সময় মৃত নারীকে সাদা রঙের গাউন পরিয়ে সঙ্গে ভারী অলঙ্কার দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হয়। বরকেও সাজানো হয় পরিপাটি করে। ছবি: সংগৃহীত

মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্য পৃথিবীতে আর নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও মৃত্যু নিয়ে আসে কিছু আনুষ্ঠানিকতাও। ধর্মের ভিত্তিতে ব্যক্তির পৃথিবী থেকে চিরবিদায় হয় কখনো জানাজার মাধ্যমে, কখনো দাহ বা শেষকৃত্যের মাধ্যমে।

আগের যুগে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও চিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হতো। সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার পাট চুকে গেছে বহু বছর হলো।

কিন্তু কখনো কি শুনেছেন মৃত মানুষের বিয়ে হচ্ছে! তাও আবার আরেকজন মৃত মানুষের সঙ্গে! মৃতদেহের প্রতি আকর্ষণ যাকে 'নেক্রোফিলিয়া' বলা হয়, এই বিয়ে কি তেমনই?

মৃত মানুষকে ঘটা করে বিয়ে দেওয়ার মতো পিলে চমকে যাওয়া বিয়ের ঘটনা ঘটে আমাদের এশিয়াতেই। চীনের 'শানসি' প্রদেশে এমন বিয়েকে বলা হয় 'গোস্ট ম্যারেজ' বা 'ভূতের বিয়ে'। মৃত ব্যক্তিকে বিয়ে দেওয়ার এই প্রথাকে বলা হয় 'মিয়াং খুন'। এমন রীতি উত্তর ও মধ্য চীন, শানসি ও হেনান প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩ হাজারের বেশি সময় ধরে পালিত হয়ে আসছে। চৈনিক বিশ্বাস মতে, একজন মৃতেরও জীবিতদের মতো চাওয়া-পাওয়া থাকে। পরকালে যাতে তারা সঙ্গীহীন না থাকে এই বিবেচনায় তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। পরকালে পর্যাপ্ত সুখী না হলে মৃতের আত্মা তার পরিবার পরিজনদের তাড়া করে বেড়াবে। এজন্য মৃতের আত্মাকে খুশি করার জন্য তাকে একজন সঙ্গী দেওয়া হয়। এমন অদ্ভুতুড়ে রীতি কেবল 'অবিবাহিত' মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ইতিহাস

পৃথিবীতে বিরাজমান যত রীতিনীতি আছে তার সবই জন্ম হয়েছে মানুষের বিশ্বাস, ভয় আর কুসংস্কার থেকে। অনেকসময় শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের উপর যে ভালোমন্দের বোঝা চাপিয়ে দেন, তা-ই যুগ যুগ ধরে 'প্রথা বা 'নিয়ম' হিসেবে পালন করা হয়।

ধারণা করা হয়, চীনের সাং সাম্রাজ্য (১৬০০-১০৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সর্বপ্রথম মিয়াং খুন নামক 'মৃতের বিয়ে' দেওয়া প্রথাটির প্রচলন শুরু করে। ওই সাম্রাজ্যের যুদ্ধরাজ চাও চাওয়ের ১২ বছরের পুত্রসন্তান মারা গেলে সম্রাট তার ছেলের বংশগতি ধরে রাখার জন্য একটি জীবিত মেয়েকে তার মৃত ছেলের সঙ্গে কবর দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, সেই থেকেই ভূতের বিয়ে চীনা উপজাতি সমাজে পালিত হয়ে আসছে।

যেভাবে হয় ভূত বিয়ে

চীনে সাধারণত বর-কনে দুজনই মৃত মানুষ থাকে, তবে আফ্রিকার নুয়ার ও আতুত নামক জনগোষ্ঠীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবিত মেয়ের সঙ্গে মৃত ছেলের বিয়ে দেওয়ার রীতি চালু আছে। মৃত পাত্রের সঙ্গে বিয়ের পর মেয়েটি আমৃত্যু তার স্বামীর বাড়িতে বিধবা বেশে বসবাস করেন।

তবে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভূত বিয়েতে ধর্মীয় আচার যতটা না কার্যকর, তার চেয়ে বেশি অর্থনীতি এখানে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। কনের পরিবার বড় অঙ্কের টাকা যৌতুক পেয়ে থাকেন বরের পরিবারের কাছ থেকে। যদিও বয়স, শ্রেণি ও বংশ মর্যাদার ওপর নির্ভর করে যৌতুকের বিষয়টি।

একজন ধর্মযাজকের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ভূত বিয়ে সম্পন্ন হয়। বর্তমানে আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চলের মত চীনেও ভূত বিয়ের নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে মৃতদেহের সঙ্গে মৃতদেহের পরিবর্তে জীবিত ব্যক্তিরও বিয়ে হয়ে থাকে। মৃত অবিবাহিত নারীকে ভূত বিয়ে দেওয়ার সময় বর নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ধরনের 'ফাঁদ' পাতা হয়। একটি লাল রঙের খামের মধ্যে অর্থ ঢুকিয়ে রাস্তার মাঝখানে ফেলে রাখা হয় এবং মৃতের পরিবার বিষয়টি আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে থাকেন। যদি কোনো পুরুষ খামটি উঠিয়ে নেন, তবেই তাকে জোর করে মৃত নারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বরের পরিবার থেকে যৌতুক হিসেবে অর্থও আদায় করা হয়।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, ভূত বিয়ের জন্য অনেকে পাত্র-পাত্রী না পেয়ে কবরস্থান থেকে মৃতদেহ চুরি করে থাকেন। ২০১৫ সালে শানসি প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে ১৪ জন নারীর মরদেহ চুরি হয় ভূত বিয়ের উদ্দেশ্যে। এসব মরদেহ চুরি করে চড়ামূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয় ভূত বিয়ে প্রয়োজন এমন পরিবারে। ২০১৯ সালে হেনান প্রদেশের মরদেহ চুরি রোধ করতে কিছু কবরস্থানে সিসিটিভি ও কংক্রিটের কফিনের ব্যবস্থা করা হয়।

২০১৬ সালে মা চংখুয়া নামের এক ব্যক্তি দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে হত্যা করে তাদের মরদেহ ৮ হাজার ৩০০ ডলারে বিক্রি করে দেয় ভূত বিয়ের জন্য।

চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এই কুসংস্কারটি এতটাই গভীর হয়ে আছে যে প্রিয়জন হারানোর বেদনার চেয়ে মৃতের বিয়ে দেওয়াটাই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

ইয়াং অয়াং নামের চীনের সাংশি হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যখনই হাসপাতালে কোনো অবিবাহিত তরুণী মারা যান, তৎক্ষণাৎ ভূত বিয়ের জন্য তার দেহ নিলামে উঠে যায়। মৃত ছেলেদের পরিবার নিলাম যুদ্ধে লেগে পড়ে মেয়েটিকে পেতে।'

বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যুর প্রহর গুনছে এমন মেয়েদের শরীর বিক্রি করা হয় ভূত বিয়ের জন্য। অনেকে আবার এই মৃত মেয়েদের সন্ধান দিতে ঘটকালীও করে থাকেন।

আনুষ্ঠানিকতা

সাধারণ বিয়ের মতই 'ভূত বিয়ে' পালন করা হয় উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে। সারাদিন অনুষ্ঠান ও কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে মৃত নারীর শরীরের হাড় পুরুষের কবরে দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও দু'জনের আলাদা কবর দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই হাড় কেনাবেচা নিয়েও প্রচুর ব্যবসা করে চীনারা।

সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা বিভাগের প্রধান হুয়াং জিংচুন জানান, কনের হাড়ের দাম অনেক বেশি বিশেষ করে যদি তারা অল্পবয়সী হয়। গবেষণা অনুসারে, হাড়গুলো ছেলের পরিবারকে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ইউয়ানে কিনতে হয়ে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ১ লাখ ইউয়ান পর্যন্ত যেতে পারে৷

ভূত বিয়েতে মৃতদেহকেও জীবিতের মত করে সাজানো হয়। বিয়ের সময় মৃত নারীকে সাদা রঙের গাউন পরিয়ে সঙ্গে ভারী অলঙ্কার দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হয়। বরকেও সাজানো হয় পরিপাটি করে। কাগজ ও বাঁশ দিয়ে বর-কনের পুতুল তৈরি করা হয়, সেই সঙ্গে আসবাবপত্র, খাবার এবং তাদের পরকালে কাজে লাগবে এমন সব খাবার তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে কাগজের পুতুলসহ সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হয় এই বিশ্বাসে যে সেগুলো মরদেহের কাছে পৌঁছে যাবে।

প্রথার প্রভাব

৩ হাজার বছরের পুরনো প্রথা হলেও একবিংশ শতাব্দীতে চীনের কিছু পশ্চাৎপদ গ্রামে এখনো ভূত বিয়ের প্রথা চলমান। তবে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথাটির বেশকিছু অন্ধকার দিক রয়েছে। যা কেবল সেই স্থান বা প্রদেশে নয় বরং পুরো দেশকেই প্রভাবিত করছে।

১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া চীনের 'এক সন্তান নীতি' এবং কন্যা শিশুর ভ্রূণহত্যার কারণে এখনো সেদেশে মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কম। এর মধ্যে ভূত বিয়ে প্রথাটি মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আছে।

চীনের গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার তরুণ কয়লা খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। তারা প্রায়ই খনি দুর্ঘটনায় কম বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। এত মৃতদেহের জন্য মেয়ে খুঁজতে গিয়ে চীনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য গার্ডিয়ান

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago