দরিদ্র দেশ রুয়ান্ডায় যেভাবে কমেছে নারী-পুরুষের আয় বৈষম্য
যদি জিজ্ঞেস করা হয় আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও রুয়ান্ডার মধ্যে মিল কোথায়— অনেকেই প্রথমে একটু ভ্রু কুঁচকবেন। নরডিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে রুয়ান্ডার মিল তো তেমন থাকার কথা না।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, প্রথম ৪টি উচ্চ আয়ের দেশ। আর মধ্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ৪৮টি সবচেয়ে অনুন্নত দেশের একটি।
দেশগুলোর সঙ্গে রুয়ান্ডার অমিল প্রায় সর্বত্র। রুয়ান্ডার মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। কিন্তু ওই ৪টি দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে।
রুয়ান্ডার তুলনায় এই দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ুও অনেক বেশি।
কিন্তু এতসব অমিলের মধ্যেও আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সঙ্গে রুয়ান্ডার একটি দিক দিয়ে মিল আছে। সেটি হচ্ছে লৈঙ্গিক সমতা। লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠার দিক থেকে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের একটি রুয়ান্ডা।
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি কীভাবে লৈঙ্গিক সমতার দিক দিয়ে এই অসাধারণ সাফল্য অর্জন করলো, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ফ্রান্সের মতো উন্নত রাষ্ট্র বহু চেষ্টা করেও পারলো না?
লিঙ্গ সমতা
লিঙ্গ সমতা বলতে এই লেখায় মূলত বোঝানো হচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর আয়ের পার্থক্য কতটা কম বা বেশি। রুয়ান্ডায় নারী ও পুরুষের আয়ের তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
তার মানে এটা না যে, দেশটি নারীদের বসবাসের জন্য আদর্শ। বরং রুয়ান্ডার চেয়ে এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো নারীদের বসবাসের ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে মূলত দেখানো হয় দেশগুলো নারী-পুরুষের আয় বৈষম্য কমাতে কী কী উদ্যোগ নিয়েছে এবং সেগুলো কতটা সফল হয়েছে।
রুয়ান্ডা কীভাবে সফল হলো
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট মূলত ৪টি বিষয়ের ওপর তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। এগুলো হচ্ছে— স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতি। এর মধ্যে অন্তত ২টি ক্ষেত্রে রুয়ান্ডা বিশ্বের বহু উন্নত দেশের চেয়ে ভালো করছে।
অর্থনীতি দিয়ে শুরু করা যাক। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের দিক থেকে রুয়ান্ডা বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দেশ। দেশটির ৮৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা মাত্র ৫৬ শতাংশ এবং সেখানে এই সংখ্যা দিন দিন আরও কমছে।
রুয়ান্ডাতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণই যে বেশি শুধু তা-ই নয়, সেখানে নারী-পুরুষের আয় বৈষম্যও নগণ্য। আফ্রিকার এই দেশটিতে পুরুষের ১ ডলারের বিপরীতে নারীর আয় ৮৮ সেন্ট। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের ১ ডলারের বিপরীতে নারীর আয় মাত্র ৭৪ সেন্ট।
২ দশকেরও বেশি সময় আগে অনেকটা বাধ্য হয়েই রুয়ান্ডার নারীরা কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে মাত্র ৩ মাসের নৃশংস গণহত্যায় দেশটিতে প্রাণ হারান প্রায় ৮ লাখ পুরুষ। গণহত্যার পর দেখা গেল রুয়ান্ডার মোট জনগোষ্ঠীর ৬০-৭০ শতাংশই নারী। জীবনধারণের জন্য কাজে যোগ দেওয়া ছাড়া এই বিশাল সংখ্যক নারীদের অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। যেহেতু অধিকাংশ পুরুষ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাই কর্মক্ষেত্রে নারীর চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল এবং তাদেরকে আগের তুলনায় বেশি বেতনও দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ যখন পুরুষরা দেশে ফিরে আসে, তখন আবারও নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়।
তাহলে রুয়ান্ডা কী এমন করলো, যা নারীদেরকে আয় বৈষম্য থেকে মুক্তি দিলো?
সহজ কথায় উত্তর হচ্ছে, নারীদেরকে কাজে রাখতে, নারীবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে এবং পুরুষের সঙ্গে আয় বৈষম্য কমাতে দেশটি বেশ কিছু আইন এবং উদ্যোগ নিয়েছিল, যা তাদের এই অসাধারণ সফলতার মূল ভিত্তি।
রুয়ান্ডায় আইন করে নারীদের জন্য ৩ মাসের বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা আছে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো নারীরা গর্ভকালীন ছুটিতে গেলে চাকরি হারাতে হয় না বা বেতন বঞ্চিত হতে হয় না।
এবার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের চিত্র তুলে ধরা যাক।
এটা স্পষ্ট যে রুয়ান্ডার নারী বান্ধব আইন ও রীতির কারণে সেখানকার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন দেশটির সংসদে নারী প্রতিনিধিদের সংখ্যার বিচারে রুয়ান্ডা বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করছে। গণহত্যার পর সংসদের ৩০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়াটাও এ ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
গবেষণা বলছে, নারীরা যখন রাজনীতি করে, তখন তারা এমন বিষয়ের ওপর জোর দেয়, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু উপেক্ষিত।
এখনো অনেক পথ বাকি
রুয়ান্ডা বিশ্বের ৫টি দেশের একটি, যারা নারী-পুরুষের আয় বৈষম্য ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সাফল্য। কিন্তু এই বৈষম্য যদি পুরোপুরি দূর করা যায়, সেটি হবে এক ঐতিহাসিক অর্জন। বিশ্বের কোনো দেশই এখনো সেই চূড়ায় পা রাখতে পারেনি।
দেশটিতে এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যা নারীদের জন্য সুখকর নয়। যেমন: গণহত্যাকালীন সময়ে নারীদের যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের বিচারে খুবই ধীরগতির অভিযোগ আছে। নারীদের প্রতি সহিংসতাও দেশটিতে ব্যাপক।
রুয়ান্ডার সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশটিতে যত মানুষ শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার, তার ৯০ শতাংশই নারী।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
Comments