মানুষ কেন মিথ্যা বলে

ছবি: সংগৃহীত

'দ্য গুড প্লেস' নামে একটি টেলিভিশন সিরিজের প্রথম সিজনের একটি দৃশ্যে এথিকস অ্যান্ড মোরাল ফিলসফির অধ্যাপক চিডি আনাগোনি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন, যখন তার সহকর্মী নতুন কেনা এক জোড়া জুতা কেমন হয়েছে সে বিষয়ে তার কাছে জানতে চান। স্পষ্টতই চিডির কাছে ওই জুতা জোড়াটি ভালো লাগেনি, কিন্তু সত্যিটা বললে সহকর্মীর অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, এটা ভেবে তিনি সহকর্মীকে জবাব দেন যে, তিনি জুতা জোড়াটি খুবই পছন্দ করেছেন। 

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই চিডির খারাপ লাগতে থাকে, কারণ তিনি সহকর্মীকে সত্যি কথাটা বলেননি। বিষয়টি তার বান্ধবীকে বলার পর বান্ধবীও এই বলে শান্তনা দেন যে 'আমরা মাঝে মাঝে বিনয়ী হওয়ার জন্য মিথ্যা বলি'। কিন্তু সহকর্মীকে মিথ্যা বলার কারণে নিজের ভেতরে যে খারাপ অনুভূতি হচ্ছিল, সেটি বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারেননি চিডি। অগত্যা সহকর্মীকে বলে দেন যে 'জুতা জোড়া খুবই বাজে হয়েছে এবং তিনি এটিকে মোটেও পছন্দ করেননি'। এ কথা শুনে সহকর্মী খুবই মর্মাহত হন। 

চিডি এবং অপর কিছু দার্শনিকের মতে, কারও অনুভূতিতে আঘাত না করাসহ মিথ্যা না বলার বাধ্যবাধকতা অন্য সব নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে অতিক্রম করে। কিছু মানুষ সত্য বলার জন্য কঠোর হতেও পিছপা হন না। যদিও মিথ্যা বলাটা আমাদের জীবনের স্বীকৃত একটি অংশ হয়ে গেছে এখন। যেমন- কেউ যদি জিজ্ঞেস করে 'কেমন আছেন' আমরা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেই 'ভালো', কিংবা কেউ তাদের অদ্ভুত চুলের স্টাইলটি কেমন হয়েছে জানতে চাইলেও আমরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেই 'দারুণ হয়েছে'। 

জীবনের সর্বত্র মিথ্যার ছড়াছড়ি থাকলেও, যখন আমাদের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলা হয়, আমরা বেশিরভাগ মানুষই সেটি ধরতে পারি না। আমাদের সঙ্গে বলা মিথ্যাটা যদি আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বিনা দ্বিধায় ধরে ফেলতে পারতাম, তাহলে কী হতো? যে টেকনোলজক্যিাল এবং সাইকোলজিক্যাল মেকানিজমের কারণে আমরা এই ক্ষমতা অর্জন করতে পারতাম, সেটি হয়ত তেমন সুখকর হতো না। বরং যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে এই যথেচ্ছ মিথ্যা, যেগুলো আমরা প্রায়শই উপেক্ষা করি, বা চোখে পড়ে না, সেগুলো আমাদের জীবনে কীরূপ প্রভাব ফেলছে।

অনেক গবেষক মনে করেন, মানুষ একে অপরের সঙ্গে তখন থেকেই মিথ্যা বলা শুরু করেছে, যখন থেকে ভাষা আবিস্কৃত হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিশাস্ত্রবিদ সিসেলা বুক বলেন, 'ক্ষমতা অর্জনের উপায় হিসেবে মিথ্যা বলাটা বাকি পথগুলোর তুলনায় অনেকটাই সহজ। কারও টাকা বা সম্পদ পেতে ব্যাংক লুট করা কিংবা কাউকে আঘাত করার চেয়ে মিথ্যা বলাটা অনেক বেশি সহজ।'

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির রুটজার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিকস এবং সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক মাইকেল লুইসের মতে, মানব ইতিহাসে পুরোটা সময় জুড়েই মানুষ ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মিথ্যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখনো বিশ্বজুড়ে মানুষ প্রতিনিয়ত মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। যদি আমরা হঠাৎ করে সহজেই মিথ্যা নির্ণয় করে ফেলতে পারতাম, তাহলে যেসব দেশে নাস্তিকতাবাদ, সমকামিতা বেআইনি কিংবা আরও ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ কড়াভাবে পালন করা হয় বা এড়িয়ে চলা হয়, সেখানকার মানুষ চরম বিপদে পড়ে যেত। 

প্রাত্যহিক জীবনেও মিথ্যার ওপর ভর করে আমরা অনেক সময় পার পেয়ে যাই। যেমন- আমরা যদি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলি- আসলে আমরা মনে মনে তাকে কী ভাবি, কিংবা অফিসের কোনো কাজের ডেডলাইন মিস করার আসল কারণ যদি আমরা বলে দেই, তাহলে আমাদের হয় পদাবনিত হবে, না হয় চাকুরিচ্যুত হব। অন্যের কাছে নিজেদের ত্রুটিমুক্তভাবে উপস্থাপনের জন্যও আমরা মিথ্যা বলি। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর অ্যাপ্লাইড সাইকোলজি এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক ক্যাঙ লি বলেন, 'সম্প্রতি আমি একটি মিটিংয়ে দেরি করে পৌঁছাই এবং আমি বলি যে সাবওয়ে ধীরগতির ছিল। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে সাবওয়ের কারণে আমার দেরি হয়নি। দেরি হয়েছে আমার নিজের ভুলের কারণে। কিন্তু আমি মনে করেছি মিটিংয়ে সবার সামনে নিজের ভুল স্বীকার করাটা আমার জন্য পেশাদার হিসেবে ভালো ফল বয়ে আনতো না।' 

তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার আইনের অধ্যাপক এবং মিথ্যা সনাক্তকরণ বিশেষজ্ঞ (লাই ডিটেকশন স্পেশালিস্ট) ক্লার্ক ফ্রেশম্যান মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে মিথ্যা ধরতে পারলে অনেক সময় উপকারও পাওয়া যেত। ফ্রেশম্যানের মতে, যদি এমন একটা দুনিয়া থাকতো, যেখানে মানুষ তার জন্য দরকারি সত্যটা জানতে পারতো, তাহলে খুবই ভালো হতো। 

'তখন আমাদের মধ্যে বিভেদ কম থাকতো এবং সাম্যতা বেশি থাকতো', বলেন ফ্রেশম্যান। 

তখন আবশ্য আমরা এখনকার চেয়ে বেশি কষ্ট পেতাম। ডিউক ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি এবং বিহেভিয়ারিয়াল ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ড্যান অরিলে বলেন, 'অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই মিথ্যাবিহীন পৃথিবী তাদের ব্যক্তিগত ইমেজের জন্য বিশাল হুমকির ব্যাপার হতো। সত্যের সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে আপনাকে আরও বেশি সৎ হতে হতো, নিজের কাজ সম্পর্কে একেবারে নির্দয় প্রতিক্রিয়া শুনতে হতো, আপনি যেভাবে পোশাক পরিধান করেন, যেভাবে চুমু খান- সব কিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়তো। আপনি বুঝতে পারতেন মানুষ আসলে আপনাকে নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় না, আপনি তাদের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না, কিংবা আপনি নিজেকে যতটা যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করেন, আপনি আসলে ততটা নন।'

অন্যদিকে, একেবারে সৎ প্রতিক্রিয়া আপনার কাজের মান ও শেখাকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করতো। তবে এই বিনিময় উপযুক্ত হতো কি না, এটা নিয়ে অধ্যাপক অরিলে নিশ্চিত নন। 

তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই সত্য কথার প্রভাব অবশ্য ভিন্ন হতো। অধ্যাপক লি বলেন, 'একবার ভাবুন তো আপনার বাচ্চা এসে বলল- বাবা-মা আমার আঁকা ছবিটা দেখ এবং আপনি ছবিটা দেখে বললেন, খুবই জঘন্য হয়েছে। তাহলে বাচ্চার ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়বেই। শিশুকালের কিছু সরলতা হয়তো তখন নষ্ট হতো। তার পরিবর্তে জীবনের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে শিশুরা আগেই ধারণা পেয়ে যেত, যা নিশ্চয় তাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো না।'

অধ্যাপক লুইসের মতে, বাচ্চারা খুব অল্প বয়স থেকে মিথ্যা কথা বলার সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে। হয়তো তার মা তাকে বলছে, তোমার দাদু ঈদে তোমাকে নতুন জামা দেবে, তুমি কিন্তু অবশ্যই বলবে যে, জামাটি তুমি পছন্দ করেছ। নাহলে দাদু মনে কষ্ট পাবে। তাই খুব অল্প বয়স থেকেই শিশুরা ভদ্রতা রক্ষার্থে মিথ্যা বলায় পারদর্শিতা অর্জন করছে।  

প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত মানুষ মিথ্যা বলাটাকে একেবারে ডাল-ভাতের পর্যায়ে নিয়ে আসে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজিস্ট বেলা ডি পাউলো ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কলেজ শিক্ষার্থীরা প্রতি তিনটি সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় (যোগাযোগ বা সম্পর্ক) অন্তত একবার মিথ্যা বলে। আর তার চেয়ে অরেকটু বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ হার প্রতি পাঁচ বারে একবার। গবেষণায় ডি পাউলো লিখেছেন, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলে, সেটা হচ্ছে তার ইতিবাচকতা নিয়ে। বাস্তবে সেসব বিষয়ে ততটা ইতিবাচক না হলেও ওপরে ওপরে একটা ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। যেমন- কেউ যদি আপনাকে অপছন্দ করে, তাহলে কোনো না কোনোভাবে সে আপনার কাছে এটি লুকাবে, বরং সে ওপরে ওপরে আপনাকে এমন মনোভাব দেখাবে যে সে আপনার প্রতি আগ্রহী। 

অধ্যাপক লুইস বলেন, 'আমরা যদি মিথ্যা ও ভনিতা ধরতে পারতাম, পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটা হতো অত্যন্ত বিপর্যয়কর। যে ধরনের সংস্কৃতিতে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াকে খুব খারাপ কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিংবা যেভাবেই হোক অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না- মানুষের এই ধরনের মনোভাব থাকে, সেখানে হরহামেশা মিথ্যা বলাটা একেবারেই জরুরি।' 

আমাদের রোমান্টিক পার্টনারদের সঙ্গেও আমরা প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলি। ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ড্রা ম্যাটস পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল, ৩৯০ জন মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৩ জনকে পাওয়া গিয়েছিল, যারা এক সপ্তাহের মধ্যে সঙ্গীর সঙ্গে 'পুরোপুরি সত্য কথা' বলেছেন বলে মনে করতে পারেননি। ২০১৩ সালে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি জরিপে ৬৭ জন মানুষের মধ্যে মাত্র দুজনকে পাওয়া গিয়েছিল, যারা এক সপ্তাহের মধ্যে সঙ্গীর সঙ্গে কোনো মিথ্যা বলেননি বলে নিশ্চিত করেছিলেন। 

দুটি জরিপেই অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে কিংবা সঙ্গী মনে আঘাত পেতে পারেন, এই ভয়ে তারা সঙ্গীদের সঙ্গে পুরোপুরি সৎ হতে পারেননি। সব প্রেমের সম্পর্কে যদি নির্জলা সত্য স্থান পেতো, তাহলে হয়তো অনেক সম্পর্কই বেশিদিন টিকতো না। 

তবে মিথ্যা ধরতে পারলে অনেক সময় সুফলও মিলতো। যেমন- প্যাথোলজিক্যাল লায়ারদের আমরা তখন সহজেই ধরতে পারতাম। এই ধরনের মিথ্যাবাদীরা নিজেদের স্বার্থের জন্য জঘন্য মিথ্যা বলতেও পিছপা হয় না। এসব মিথ্যা অনেক সময়ই অনেক মানুষকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে। অধ্যাপক লুইসের মতে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন এই ধরনের মিথ্যাবাদীর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। তার মিথ্যা বলার অভ্যাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ নানাভাবে ভুগেছে। 

রাজনীতিতে মিথ্যা বলার চল অবশ্য নতুন না। বাঙ্গোর ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতার অধ্যাপক ভিয়ান বাকির বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনীতিতে ব্যবহৃত মিথ্যাগুলো অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এসব মিথ্যার ক্ষতিটা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন বা তাদের মতো নেতারা মিথ্যা বলাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন এবং এসব মিথ্যা ধরা পড়লে কী হতে পারে, সে বিষয়ে তারা এখন আর নজর দেন না।'

শুধু যে ব্যক্তি মিথ্যা বলেন তা না, প্রতিষ্ঠানও অনেক সময় মিথ্যা বলে। যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে যে 'লিভ ক্যাম্পেইন' হয়েছিল, সেখানে বারবার প্রচার করা হয়েছিল যে ইইউর পেছনে যুক্তরাজ্যের প্রতি সপ্তাহে খরচ ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড, যেটিকে যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ 'তথ্যের পরিপূর্ণ অসদ্ব্যাবহার' বলে আখ্যায়িত করেছিল।

মিথ্যা কথা যদি এভাবে সবাই বুঝে ফেলতো, তাহলে বৃহৎ পরিসরে সমাজের কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হতো সেটা নিশ্চিত না। তবে যাই হতো, সেটা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার চেয়ে ভালোই হতো। মানুষ সবসময়ই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যদি মিথ্যা বলে কিছুর অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে 'অসৎ', 'দুর্নীতি' ইত্যাদি শব্দেরও অস্তিত্ব থাকতো না। 

সূত্র: বিবিসি

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English

The constitution: Reforms only after a strong consensus

Constitutional reforms should be done after taking people’s opinions into account, said Dr Kamal Hossain, one of the framers of the constitution.

4h ago