তেলাপোকা থেকে বাঘ, সবকিছুই খেয়ে ফেলতেন যিনি

তিনি একজন জুয়োফেইজ। অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর সব প্রাণীর অন্তত একটি করে খেয়ে দেখতে চান যিনি।
উইলিয়াম বাকল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

১৮৩০ সাল। ব্রিটেনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী উইলিয়াম বাকল্যান্ডের বাড়িতে রাতের খাবার প্রস্তুত। ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার। মেন্যু কী হতে পারে? টার্কি, খাসির রোস্ট নাকি শুকরের মাংস? মজার ব্যাপার হলো- মেন্যুতে এর কোনোটাই নেই। ঢাকনা তুলতেই দেখা গেল ব্রেডের ওপর ছোট্ট ইঁদুর ফ্রাই করা।

উইলিয়াম বাকল্যান্ডের প্রিয় মেন্যু এটি। তিনি একজন জুয়োফেইজ। অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর সব প্রাণীর অন্তত একটি করে খেয়ে দেখতে চান যিনি।

বাকল্যান্ডের জন্ম ১৭৮৪ সালে, ইংল্যান্ডের ডেভেনশায়ার শহরে। লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওলজি বা ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা প্রথম ব্যক্তি তিনি। তার আগ্রহের বিষয় ছিল- পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য, ইতিহাস ও ভৌগোলিক গঠন। ভূতত্ত্বের পাশাপাশি জীবাশ্ম, প্রাণিবিদ্যা নিয়েও আগ্রহের কমতি ছিল না। পরে অক্সফোর্ডেরই অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাকল্যান্ড।

ডাইনোসরের আবিষ্কারক বাকল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে পড়ানোর জন্য সুনাম ছিল তার। ক্লাসে লেকচার দেয়ার সময় হায়েনার মাথার খুলি হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করেন, 'বলো তো এই দুনিয়াটা চালায় কে?' উত্তরে শিক্ষার্থীরা বলেন, 'এ নিয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই'। তখন বাকল্যান্ড বলেন, 'এই পেট, বুঝলে মানুষের এই পেটই পুরো পৃথিবীকে চালাচ্ছে।' বাকল্যান্ড আজীবন তার এই কথার সঙ্গে কাজে মিল রেখে চলেছেন।

সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকলিমেটাইজেশন অব অ্যানিম্যালসের সদস্য ছিলেন বাকল্যান্ড। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব ধরণের প্রাণী ব্রিটেনে আমদানি করতে পারতেন তিনি। এজন্যই তার রাতের খাবারের তালিকায়- কুমির, চিতা বাঘ, ক্যাঙ্গারু, হেজহগ, ডলফিনের মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী, পোর্পোইস, মোল, এমনকি ইয়ারউইগের মতো নানা কীটপতঙ্গ থাকতো।

নানা ধরনের প্রাণী খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব প্রাণীরা কংকাল বা জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণার শখ ছিল বাকল্যান্ডের।

তার বাড়িটাও ছিল যেন একটা চিড়িয়াখানা। বাকল্যান্ডের স্ত্রী ম্যারিও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতেন। দুজন মিলেই চালাতেন নানা গবেষণা। বাড়িতে তাই জীবিত, মৃত নানা প্রাণীর নমুনা থাকতো। বাচ্চাদেরও এসব বিষয়ে পড়াতেন তারা। বাচ্চারা খেলাধুলার চেয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অংশ নিতে বেশি পছন্দ করতো। তাই মাঝে মাঝে বেশ উদ্ভট সব দৃশ্য দেখা যেত বাকল্যান্ড-ম্যারির বাসায়।

জীবজন্তুর হাড় নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত বাকল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

যেমন- ডাইনিং টেবিলে কেক বানানোর ক্রিম ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর কচ্ছপকে হাঁটতে দিতেন তারা, পায়ের ছাপ সংগ্রহের জন্য। তারপর সেই পায়ের ছাপের সঙ্গে প্রাচীনযুগের কচ্ছপের পায়ের ছাপ মিলিয়ে দেখতেন।

বাকল্যান্ড ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, বাইবেলে উল্লেখিত মহাপ্লাবন শুধু একটা গল্প নয়, সত্য ঘটনা। তাই বাইবেলের সেই নোয়ার কাহিনী ভূতাত্ত্বিক প্রমাণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছিলেন তিনি।

ব্রিটেনের নর্থ ইয়র্কশায়ারের একটি গুহায় হায়নাসহ বেশ কিছু প্রাণীর কংকালের অংশ পাওয়ার পর তা পরীক্ষা করে অবাক হন। এরপরই বাইবেলের মহাপ্লাবনের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। ওই বন্যায় যে সব প্রাণী ভেসে যায়নি এবং ওই একই সময়ে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় থেকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পরিণত, পরবর্তীতে তারই প্রমাণ দিয়েছিলেন বাকল্যান্ড।

ওইসময়ের আরেকটি রহস্যেরও ব্যাখ্যা দেন বাকল্যান্ড। সেটি ছি ডাইনোসর। ১৮২৪ সালে অক্সফোর্ডশায়ারের একটি পাথরের কোয়ারিতে প্রথম বিশাল সরীসৃপের হাড় আবিষ্কার করেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। নাম দেন 'মেগালোসরাস'। এটি ছিল পৃথিবীতে ডাইনোসর আবিষ্কারের প্রথম বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ।

পরে ডাইনোসরের ওই হাড় ফরাসি শারীরতত্ত্ববিদ জর্জেস কুভিয়ারকে দেখান তিনি। তারা দু'জন মিলে টিকটিকির সঙ্গে ডাইনোসরের ওই হাড়ের মিল খুঁজে পান। ব্রিটেনে ডাইনোসরের বিবর্তন নিয়ে গবেষণায় বাকল্যান্ড ও কুভিয়ারের অবদান ছিল অসামান্য। 

মেগালোসরাস, বাকল্যান্ডের আবিষ্কার করা ডাইনোসরের হাড়। ছবি: সংগৃহীত

১৮২০ সালে বাকল্যান্ডের লেখা 'ভিনদিসিয়া জিওলোজায়' (Vindiciae Geologiae) প্রকাশিত হয়, যাতে বাইবেলের সঙ্গে ভূ-তত্ত্বের বিশদ ব্যাখা দেন তিনি।

পৃথিবীর সব প্রাণী খেয়ে দেখার যে ইচ্ছে, সেই চ্যালেঞ্জ শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেননি বাকল্যান্ড। তবে এই ব্যর্থতা তাকে অন্য কিছু খাওয়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়।

ইতালির একটি ঐতিহাসিক ক্যাথেড্রালে চুনাপাথরের দেয়ালও চেখে দেখেছিলেন তিনি। প্রচলিত ছিলো, ওই দেয়ালে ঈশ্বরের একজন দূতের রক্ত লেগেছিল। তবে বাকল্যান্ড তার স্বাদ সংক্রান্ত দক্ষতা দিয়ে এই উপসংহারে পৌঁছান যে, দেয়ালে আসলে বাদুরের প্রসাব লেগেছিল।

তবে বাকল্যান্ডকে নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি ১৮৪৮ সালের। একদিন তৎকালীন লর্ড হারকোর্টের বাড়িতে নৈশভোজের দাওয়াত ছিল তার। হারকোর্ট পরিবারের কাছে ছিল একটি রূপালী লকেট। ক্রিস্টালের ওই লকেটের ভেতরে ছিল- ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশের লুইয়ের মমি করা হৃদপিন্ড। হাই-প্রোফাইল অতিথিদের দাওয়াত দিলেই লকেটটি প্রদর্শন করতো হারকোর্ট পরিবার। ওইবার নৈশভোজের সময় লকেটটি বাকল্যান্ডের হাতে পড়লে তিনি বলেন, 'জীবনে অনেক অদ্ভুত জিনিস খেয়েছি আমি, কিন্তু কখনো কোনো রাজার হৃদপিন্ড খাইনি।' এই বলে ওই লকেটটি মুখের ভেতরে নিয়ে নেন এবং চেখে দেখেন।

বলা হয়, ভিক্টোরিয়ান যুগে যেসব বিখ্যাত পাগলাটে বিজ্ঞানী ব্রিটিশ ইতিহাসে তাদের চিহ্ন রেখে গেছেন, তারমধ্যে বাকল্যান্ড একজন।

ফরাসী রাজা চতুর্থদশ লুই (বামে)ও তার হৃদপিন্ড (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

পাগলাটে হলেও বাকল্যান্ডের অবদান অনেক। ইংল্যান্ডে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের ডিন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামের কিউরেটর ও লন্ডনে ভূ-তাত্ত্বিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন তিনি। গ্রেট ব্রিটেনের ভূ-তাত্ত্বিক জরীপ, স্কুল অব মাইনস ও মাইনিং রেকর্ড অফিস প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি

১৮৫৬ সালে মারা যান বাকল্যান্ড। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ব্রিটেনের বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় তাকে।

বাকল্যান্ডের সমাধী নিয়ে তার এক শিক্ষার্থী মজা করে কবিতাও লিখেছেন। সেখানে বলা হয়, 'আমাদের এই মহান প্রফেসরের হাড়-গোড় কোথায় শান্তিতে থাকবে? যদি পাথরের কোনো ভাস্কর্যের নিচে তাকে সমাধীস্থ করা হয়, তবে সব ভেঙে তিনি বের হয়ে আসবেন এবং চারপাশে সবকিছু পরীক্ষা করা শুরু করবেন।'  

তবে বাকল্যান্ডের গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন প্রাণী খাওয়ার যে বাতিক, সেটা তিনি রেখে যান ছেলে ফ্রাংক বাকল্যান্ডের মধ্যে। ফ্রাংক তার বাবার মতোই উদ্ভট এই খাওয়া চালিয়ে যান।

উইলিয়াম বাকল্যান্ড এর পোর্টেট।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাকল্যান্ডের ডাইনোসর আবিষ্কারের ২০০ বছর উদযাপন করে

বিজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা যেকোনো জায়গা থেকেই শুরু হতে পারে- সেটা আপনার বাড়িও হতে পারে। আর বড় বড় বিজ্ঞানীদের জীবন-যাপনও যে কতো মজার হতে পারে তার দৃষ্টান্ত উইলিয়াম বাকল্যান্ড। 

তথ্য সূত্র: বিবিসি, দ্যা গার্ডিয়ান, অল দ্যাটস ইন্টারেস্টিং

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago