সাদি মহম্মদের তীব্র অভিমান ও কিছু প্রশ্নদায়

বেঁচে থাকতেই মানুষটা স্পষ্ট বলে গেছেন—‘আমাকে যেন কোনো মরণোত্তর পদক না দেওয়া হয়।’ কী অভিমানে, কত ব্যাথায় এমন মহীরুহ শিল্পী এই কথাটা বলে যেতে পারেন। সেই বিষাদের ওজন কী কেউ মেপে দেখেছেন?
সাদি মহম্মদের সান্নিধ্যে লেখক (বামে)। ছবি: তানভীর তারেকের সৌজন্যে

এ দেশে রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট বিক্রির শীর্ষ তালিকায় দুজন শিল্পীর অডিও ক্যাসেট সর্বাধিক বিক্রিত হয়েছে—একজন কাদেরী কিবরিয়া, আরেকজন সাদি মহম্মদ। স্ব স্ব শিল্পীর প্রকাশকরাই বলেছেন এ কথা।

পরবর্তী পর্যায়ে এই দুজন শিল্পীর সঙ্গে ডুয়েট গাইবার জন্য অনেকেই আকুল ছিলেন। সাদি মহম্মদ অবলীলায় অনেককেই সেই সাপোর্টটি দিয়েছেন।

রবীন্দ্রসংগীতকে মধ্যবিত্ত মফস্বলের গলিতে গলিতে পৌঁছে দেন সাদি মহম্মদ। তৈরি করেছেন একাধিক শিল্পী। শিক্ষকতা করেছেন তিনি। তার মতো প্রিয় শিক্ষকের আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

ব্যক্তিগতভাবে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে ভক্ত হিসেবে পরিচয় সেই ক্যাসেট ইনলে'তে দেখেই। এরপর ঢাকার জীবনে প্রথম কথা হয় একটি ইভেন্টের প্রয়োজনে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটি ইভেন্ট করবো আমরা। প্রায় দুইযুগ আগের কথা। সেখানে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু হবে। কিন্তু শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় নেই। এর উপরে শুনলাম, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা খুব রাসভারি হয়ে থাকেন। নতুন আয়োজকদের কথা নাও শুনতে পারেন।

তবুও সাদি ভাইকে সাহস করে ফোন দিলাম। তখনো সেলফোনের যুগ আসেনি। ল্যান্ডফোনেরও ওপারে তিনি এতটাই আপন হয়ে কথা বললেন, যেন আমি তার অনেক দিনের চেনা! আমি তার সম্মানি নিয়ে কথা বলতেই বললেন—'ওগুলো দিও। টেনশন করো না।'

এরপর তিনি তার সংগঠন রবিরাগ'র ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিশাল আকারে রিহার্সাল করে অনুষ্ঠানটি একাই সাজিয়ে দিলেন। অথচ তার আগে মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। আমাকে একরকম বাঁচালেন। প্রকৃত অর্থে বড় মাপের মানুষকে এতটা সরল হতে আমি আর দেখিনি।

সাদি মহম্মদকে নিয়ে এসব সারল্যের গল্প বলে শেষ করা যাবে না। এসব গল্প এই লেখাতেই বিশেষ করে উল্লেখ করার প্রয়োজন, কারণ এসব সরল মানুষকে আমরা অনেকেই ব্যবহার করি।

প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। আমেরিকার এক পরিচিত ইভেন্ট অর্গানাইজার এলেন, সাদি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হবেন এবং সাদি মহম্মদসহ একাধিক শিল্পী নিয়ে অনুষ্ঠান করবেন নিউইয়র্কে। আমি বাসায় নিয়ে গেলাম তাকে, পরিচয় করালাম।

আয়োজক বাকি শিল্পীদের রিকমেন্ডেশেনের জন্য সাদি ভাইয়ের সিগনেচার নিলেন। সাদি মহম্মদের প্যাডে। তার মাস ছয়েক পরের অনুষ্ঠান। সব কাগজে নিজ দায়িত্বে সাদি মহম্মদ সই করে দিলেন।

আয়োজক কথা দিলেন—তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গাইবেন সাদি মহম্মদ। এবারে সাদি ভাই মুচকি হাসলেন। আয়োজককে বললেন—'শোনো, তুমি আমায় আমেরিকা নিয়ে যাবে কী না আমার সন্দেহ আছে! সে বিষয়ে প্রশ্নও নেই। আমারও চাওয়া নেই। তুমি তানভীরের সঙ্গে এসেছ। এটাই যথেষ্ট। ও আমার খুব আদরের একটা ভাই। তাই যা কিছু লাগে করে দিয়েছি। কোনো দ্বিধা করো না। এরকম আমার জীবনে হয়েছে। শেষে হয়ত সবাই যাবে, আমি যেতে পারবো না।'

আয়োজক তো দিব্যি কেটে অস্থির। বললো—কেউ না গেলেও আপনি যাবেন। অথচ বাস্তব চিত্র ঘটল উল্টো। সবাই গেলেন, সাদি ভাই ছাড়া। সাদি ভাইয়ের জায়গায় তারা... থাক সে কথা আজ!

সাদি ভাই আমার হাত চেপে ধরে বলেছিলে, 'দেখিস তানভীর, বাকি সবাই যাবে, আমার জায়গায় অন্য একজন যাবে। আমার যাওয়া হবে না।' ঠিক তাই হলো! আমি লজ্জায় সাদি ভাইকে ফোন দিচ্ছি না কিছুদিন। পরে সাদি ভাইই আমার আড়ষ্টতা ভাঙলেন—'আরে পাগল, এগুলো আমার জীবনে দেখা।'

অফ দ্য রেকর্ড অনেক কথা বলতেন। বলতেন, আমি এমন অনেক কলিগকে নিয়ে অ্যালবাম করিয়েছি, যাদের কেউ কেউ বিখ্যাত হয়েছে। পরে ওদেরই কেউ আমার কোনো কাজের ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ে বলে বাধা দিয়েছে। অনাস্থা প্রকাশ করেছে! এসব অবজ্ঞার গল্পগুলো বলতেন, আর শিশুর মতো আনমনা হয়ে যেতেন। কেন মানুষ এমন হয়?

সাদি ভাইয়ের মোহাম্মদপুরের বাড়িটা ছিল একেবারে প্রিয় মানুষদের জন্য নিজের বাড়ির মতো! সেখানে গেলে না খাইয়ে কাউকে যেতে দিতেন না।

আরেকটি বিষয় হলো—সাদি মহম্মদ কাউকে কোনো কিছু ভদ্রতার খাতিরে বলতেন না। যাকে যা বলতেন সরল বিশ্বাসে ভালবেসে বলতেন। যেমন: একবার এক অনুষ্ঠানে সাদি ভাই নিজের ডিজাইন করা ফতুয়া পরে গেলেন। প্রায় সবসময় তাই করেন। নিজের ডিজাইন পোশাক পরতেন তিনি। সেখানে আমি একবার শুধু বলেছি—'সাদি ভাই, আপনার ফতুয়াটা ভারী সুন্দর তো!'

সাদি ভাইয়ের জবাব, 'তোর ভাল লেগেছে।' আমি ভেবেছি, এরকম অনুষ্ঠানে তো কতজনই কতভাবে বলে। সাদি ভাই নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। এমনকি আমিও ভুলে গেছি!

দুদিন পর ঠিক সাদি ভাই ফোন করলেন। 'তানভীর, তোর জামার সাইজটা বল।' ঠিকঠিক কদিন পর ফতুয়া বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। হৃদয় জোড়া তুমুল মায়া ছিল তার মানুষের জন্য!

সেই মানুষটাকে তার কাছের মানুষদের কাছে শুধুই অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। তার খুব কাছের, একাধিক চেনা মানুষ করপোরেট জগতের বিশাল পদে আসীন। আমি জিজ্ঞেস করতাম—'সাদি ভাই আপনার একক অনুষ্ঠান বিশাল আয়োজনে হওয়া দরকার। কেন হয় না। আপনার জন্য তো স্পন্সর ওয়ান টুর ব্যাপার।'

সাদি ভাই হাসতেন। সে হাসিতে যে কত বিষাদ ছিল। কত বেদনা ছিল। বলে বোঝানো যাবে না! একবার ভেবে দেখুন তো—সাদি মহম্মদের বিরাট আয়োজনে কোনো একক শো হয়েছে কি না! হয়নি। এ লজ্জা কার?

অথচ, তার স্বেচ্ছামৃত্যুর পর কেউ কেউ তার ডিপ্রেশন নিয়ে নানান মনগড়া কথা বলেছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রের ওপর দায় চাপানোকে অনর্থক বলেছেন। আমি তাদের খেয়াল করলাম। খোঁজ নিলাম। জানলাম, তারা কেউই সাদি ভাইয়ের সঙ্গে আলাপের সম্পর্কেও ছিলেন না। গত এক দেড়যুগে সাদি ভাইয়ের সঙ্গে তারা কোনো কথাও বলেননি। তারাই সাদি মহম্মদের মৃত্যুর পর নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে ফেললেন!

একজন মহীরুহ শিল্পী কোনো পদকের জন্য কাজ করেন না। খুবই সরল সত্য। কিন্তু পদক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে শিল্পীকে যথাসময়ে সম্মান জানানোর দায়িত্বটা কার? নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। আমি এক মাস আগে একটি রাষ্ট্রীয় পদকের কিছু নাম দেখে অবাক হয়েই কজন শিল্পীর ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। সেই পদক প্রাপ্তির তালিকায় দুয়েকজন অযৌক্তিক নাম দেখে প্রিন্স মাহমুদসহ অনেকেই প্রতিবাদ তোলেন।

আমি কজনার ছবিসহ একটা পোস্ট দেই ফেসবুকে। সেই ছবিগুলো ছিল সাদি মহম্মদ, রফিকুল আলম, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, মাকসুদুল হকের। এ ছাড়া, লিখেছিলাম যে নিয়াম মোহাম্মদ চৌধুরীও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাননি।

সেই পোস্টের লেখা পড়ে সাদি ভাই ফোন করেছিলেন। 'এগুলো ওরা আমাকে দেবে না। খামাখা এগুলো লিখিস নাতো!' একজন জাত শিল্পীর ভেতরের হাহাকার বুঝতে পারে যে কেউ। এটা কিন্তু পদকের লোভ না। রাষ্ট্রের কাছে একটু আদরের আকাঙ্ক্ষা। তার ছোটভাই বরেণ্য নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদকেও বলে গেছেন। সাদি মহম্মদের খুব কাছের ছাত্রী ড. অণিমা রায়কে অনেকবার এসব বিষয়ের আক্ষেপের কথা বলতেন।

সাদি মহম্মদ সেই মানুষটা, যার আঁকা বাংলাদেশি পতাকা তার মা সেলাই করে মোহাম্মদপুরে উড়িয়েছিলেন বলে সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকা ওড়ানোর দুঃসাহসেই পাক হানাদার বাহিনী তাদের টার্গেট করে। তার বাবাকে সন্তানদের সামনে হত্যা করে। এমন মানুষকে আমরা ৬৭ বছরের কোনো বছরেই মনে হয়নি স্বাধীনতা পদকের জন্য তার নাম প্রস্তাব করি, অথবা একুশে পদক তার গলায় দিয়ে পদকটির যথার্থ মূল্যায়ন করি। না, সেটা হয়নি এবং একজন শিল্পীমন দীর্ঘজীবন সংগীতে নিবেদন করার পর রাষ্ট্রের কাছে এই সম্মানের চাওয়াটুকু অন্যায় নয়। বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

অবসরে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন। তার অগণিত ছাত্র-ছাত্রী এখন বড় বড় অবস্থানে। তাদের শুধু সংগীতটাই শেখাতেন না, বরং শেখাতেন শিষ্টাচার। মানুষের কাছে নির্মোহ থাকা।

মূলত এসব প্রবঞ্চনা দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্র সম্মিলন পরিষদের নানা কমিটি, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের একাধিক উপকমিটিতে কারা থাকেন? সাদি মহম্মদকে কি ভেবেছেন কখনো? কেউ মনে রাখেনি। এমন একজন শিল্পী শুধু দেশকে দিয়েই গেলেন। তাই সাদি মহম্মদ যেন অনেক আগেই নিজের অভিমানী লাশটি বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সঙ্গে যোগ হয় মা আর বোন হারানোর শোক।

বেঁচে থাকতেই মানুষটা স্পষ্ট বলে গেছেন—'আমাকে যেন কোনো মরণোত্তর পদক না দেওয়া হয়।' কী অভিমানে, কত ব্যাথায় এমন মহীরুহ শিল্পী এই কথাটা বলে যেতে পারেন। সেই বিষাদের ওজন কী কেউ মেপে দেখেছেন?

সেই অভিমানে তাকে শহীদ মিনারে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এই লজ্জা কী আমাদের বা তার কাছের সহকর্মীদের নয়? রাষ্ট্রকে শুধু দিয়েই গেলেন মানুষটি! শহীদ পিতার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে চোখের সামনে বাবাকে হত্যা করা দেখতে হয়েছে। সেই ট্রমা নিয়ে বেঁচেছিলেন শুধু গানটা নিয়ে।

সাদি ভাই বলতেন, 'তানভীর, অনেকেই আমার বাবার মৃত্যুর গল্প শুনে বলেন, আপনার তো পাগলা গারদে থাকার কথা! এত নির্মমতা কীভাবে সয়েছেন?'

সত্যিই অসহ্য অগণিত নির্মমতা সয়েছেন এই জাত শিল্পীটি তার একটা জীবনে। এতো নির্মোহ মানুষ আর একটাও ছিল না। চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের একটুখানি আদর। বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেলেন প্রবঞ্চনা, বারবার!

রাষ্ট্র অনেককে নিয়ে তুমুল উৎসব করবে। অথচ প্রকৃত নির্মোহ শিল্পীদের অনেককে রেখে দেবে অন্ধকার। ঠিক তাই যেন তীব্র অভিমানে.. নিজের তানপুরাটা ছেড়েই স্বেচ্ছামৃত্যু!

এই নোংরা সিস্টেমকে চপেটাঘাত দিয়ে যেন বিদায় দিলেন নিজের অভিমানের। সাদি মহম্মদ যেন খুব পরিকল্পনা করেই জানান দিতে চাইলেন, অবহেলা, সমাদর না পাওয়ার পুঞ্জিভূত আক্ষেপগুলোর সব উত্তর। রাষ্ট্র প্রকৃত শিল্পীকে লালন না করতে জানলে এ বিষাদ বাড়বে আরও। এ বিষাদের দায় আমার, আপনার, অনেকের।

বিদায়—হে রবীন্দ্রসংগীতের রাজা।

ভালো থাকবেন থাকবেন আপনি।

লেখক: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক

Comments

The Daily Star  | English

Price hike of essentials: Poor, middle class in a tight corner

Harunur Rashid, a retired government employee, was taken aback by the steep price rise of okra at the capital’s Karwan Bazar yesterday.

6h ago