ইউক্রেনের খাদ্যশস্য যে কারণে বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে প্রবল ঘাটতি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর বিশ্বে খাদ্য জোগানে ইউক্রেনের গুরুত্ব কতটুকু তা অন্যান্য দেশ বুঝতে পারছে।

ইউক্রেন বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিভিন্ন খাদ্যশস্য যেমন: গম, ভুট্টা, বার্লি ও তৈলবীজ রপ্তানি করে থাকে। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলোকে অবরোধ মুক্ত করলেও রপ্তানিপ্রক্রিয়া এখনো হুমকির মুখে।

যুদ্ধ পূর্ববর্তী বিশ্বে খাদ্যশস্য যোগানে ইউক্রেনের ভূমিকা

ইউক্রেনের সমতল উর্বর মাটি চাষের জন্য আদর্শ। যুদ্ধের পূর্বে, আন্তর্জাতিক বাজারে কেনা সব খাদ্য ক্যালোরির ৬ শতাংশ ইউক্রেন একাই উৎপাদন করত। অন্যদিকে, রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক, কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইউক্রেন সাধারণত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক। যা সাধারণত বিশ্বের ৪২ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ১৬ শতাংশ ভুট্টা এবং ৯ শতাংশ গম উৎপাদন করে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, ইউক্রেন এবং রাশিয়া সাধারণত আফ্রিকার ৪০ শতাংশের বেশি গম সরবরাহ করে।

১৯ শতকে ইউরোপের দ্রুত বর্ধনশীল ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরগুলোর জনসংখ্যাকে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইতিহাসের গতিপথকে রূপ দিতে সাহায্য করেছিল। এমনকি, দেশটি কয়েক দশকের বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে টিকিয়ে রেখেছিল। যুদ্ধের পূর্বে, ইউক্রেন সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বেশি শস্য রপ্তানি করতো এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য করা সূর্যমুখী বীজ ও তেলের প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করতো।

যুদ্ধ চলাকালীন উৎপাদন ও রপ্তানির অবস্থা

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ৯০ শতাংশ খাদ্য রপ্তানির করতো। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রুশ বাহিনী আক্রমণের পর ইউক্রেনের ইউরোপীয় এবং মাইকোলাইভের মূল রপ্তানি টার্মিনালগুলোতে অবরোধ আরোপিত হয়। যার ফলে ইউক্রেনের রপ্তানি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

সমুদ্র বন্দরগুলো অবরুদ্ধ থাকায় দেশটি ট্রাক ও ট্রেন ব্যবহার করে স্থলপথে যতটা সম্ভব রপ্তানি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ২০২১ সালে তোলা প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন শস্য তখনো ইউক্রেনে আটকে ছিল।

চলতি বছরের জুলাই মাসে শস্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন। যেখানে আগের বছরগুলোতে মাসিক প্রায় ৫ মিলিয়ন টন শস্য রপ্তানি হত। ২০২১ সালে ইউক্রেন প্রতি মাসে গড়ে ৪ মিলিয়ন টন শস্য (গম, ভুট্টা এবং বার্লি) এবং ৪ লাখ ৩০ হাজার টন সূর্যমুখী তেল রপ্তানি করেছে। 

ইউক্রেনিয়ান গ্রেইন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাইকোলা গর্বাচভ বলেছেন, যুদ্ধের কারণে শিপিং খরচ টন প্রতি ১৬০ ইউএস ডলার থেকে ১৮০ ইউএস ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, 'আমার মনে হয়, ৫০ শতাংশেরও বেশি কৃষক আগামী কয়েক মাসে দেউলিয়া হয়ে যাবে।'

২০২২ সালে শস্য ও তৈলবীজের উৎপাদন ৬৯ মিলিয়ন টন হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। অথচ যা ২০২১ সালে ১০৬ মিলিয়ন টন ছিল।

ইউক্রেন ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে ৫৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন গম, ভুট্টা এবং বার্লি রপ্তানি করে। কিন্তু ২০২০ থেকে ২০২১ সালে ৪৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন টনে নেমে আসে। আর সেখানে ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে, ইউক্রেনিয়ান গ্রেইন অ্যাসোসিয়েশন দেশের গম রপ্তানি ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন অনুমান করছে।

উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহতের কারণে বিশ্বে প্রভাব

ইউক্রেনের শস্যের উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যহত হওয়ার কারণে অন্যান্য দেশে প্রভাব বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যখন গম, ভুট্টা, চাল এবং বার্লির মতো শস্যের কথা আসে, তখন বড় বড় রপ্তানিকারকরা লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন বা এমএমটি হিসেবে কথা বলে। একটি একক এমএমটি গমে প্রায় ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ফুড ক্যালোরি থাকে, যা ইউরোপের প্রতিটি মানুষকে প্রায় ২ দিনের জন্য বা আফ্রিকার সমগ্র জনসংখ্যাকে প্রায় দেড় দিন খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।

আর ইউক্রেন ২০২১ সালে প্রায় ৮০ এমএমটি শস্য যার মধ্যে রয়েছে গম, ভুট্টা এবং বার্লি উৎপাদন করেছিল এবং আশা করা হচ্ছে যে এই বছর এর অর্ধেকেরও কম ফসল উৎপাদন হবে। ৪০ এমএমটি এর মত ঘাটতি কত বিশাল, তার একটি উদাহরণ দিলে বুঝা যাবে। ৪০ এমএমটি খাদ্যের ক্যালোরি, যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশের জনসংখ্যাকে ৩ বছর ধরে চালাতে পারবে।

এবার উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং মরক্কো দেশগুলোতে প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনের গম রপ্তানির উদ্দেশ্য ছিল। যারা প্রত্যেকে এক মিলিয়ন টন ইউক্রেনীয় গম আশা করছে।

ইউক্রেন থেকে রপ্তানি কমে যাওয়ায় এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের আমদানি-নির্ভর দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।

যুদ্ধের কারণে আফ্রিকায় ৩০ মিলিয়ন টন খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং মহাদেশ জুড়ে খাদ্যের দাম ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইজেরিয়াতে পাস্তা ও পাউরুটির মতো খাদ্যের দাম ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

একইভাবে, ইয়েমেন সাধারণত ইউক্রেন থেকে বছরে এক মিলিয়ন টনের বেশি গম আমদানি করে। জাতিসংঘ বলছে, জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ইয়েমেনে আটার দাম ৪২ শতাংশ এবং রুটির দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ইউক্রেনীয় গমের আরেক বড় আমদানিকারক সিরিয়ায় রুটির দাম দ্বিগুণ বেড়েছে।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামেও ইউক্রেন অনেক বেশি অবদান রাখে।

খাদ্যের ঘাটতি বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করছে এবং মে মাসে জাতিসংঘের ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছিল, ৪৩টি দেশ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়া গত বছর তাদের গম সরবরাহের জন্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল ছিল। যেখানে, তানজানিয়া, নামিবিয়া ও মাদাগাস্কার গমের জন্য ৬০ শতাংশের বেশি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

পরবর্তী ফসলের মৌসুমে অবস্থা কেমন হবে?

যুদ্ধ মানে এ বছরেও ফসল কম হবে। খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লরা ওয়েলেসলি বলেছেন, ইউক্রেন সাধারণত যে ৮৬ মিলিয়ন টন শস্য উৎপন্ন করে তার ৩০ শতাংশ ফসল সামনে তোলা হবে না।

রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, দ্বন্দ্বে কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত বা কমে যাওয়ার কারণে এ বছরের ফসল গত বছরের তুলনায় অর্ধেক হতে পারে। যে কৃষকরা তাদের ফসল সংগ্রহ করতে সক্ষম, তাদের সেগুলো সংরক্ষণ করার জন্য জায়গা থাকবে না। কারণ সংরক্ষণের জায়গাগুলো এখনো গত বছরের শস্যে পূর্ণ। সঞ্চয় ক্ষমতার অভাব, সঙ্গে আয়ের পতন এক হয়ে কৃষকদের বীজ কেনার ক্রয়ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলেছে। যার মানে রপ্তানি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

বর্তমান অবস্থা

যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম, রাশিয়া-ইউক্রেন জাতিসংঘ ও তুরস্কের সঙ্গে 'মিরর চুক্তি' স্বাক্ষরের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরে একটি 'সমুদ্র করিডোর' উন্মুক্ত করেছে। চুক্তিতে প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন টন ইউক্রেনীয় শস্য ও তৈলবীজ দেশের কৃষ্ণ সাগর বন্দর ছেড়ে যেতে পারবে।

চলতি বছরের, ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরে নৌ-অবরোধের পর পয়লা আগস্ট এই প্রথম একটি কার্গো জাহাজ ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর থেকে ২৬ হাজার টন ভুট্টা নিয়ে লেবাননের উদ্দেশ্যে ছেড়েছে।

তবে ইউক্রেনে এখনো রপ্তানির জন্য প্রায় ২০ মিলিয়ন টন শস্য আটকে আছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এ বছরের ফসল কাটার পরে এটি ৭৫ মিলিয়ন টনে পৌঁছাতে পারে।

কৃষ্ণ সাগরের নতুন মিরর চুক্তিটি রপ্তানি বৃদ্ধির আশার সঞ্চার করলেও কিছু বিপত্তি এখনো বিদ্যমান। এই পরিকল্পনাটির সাফল্য ক্রেমলিনের চুক্তি মেনে চলার উপর নির্ভর করে এবং এখনো যুদ্ধের মাঝে আটকে থাকা শস্য বহন করার জন্য জাহাজ, ক্রু ও বীমা সুরক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

অন্যদিকে, চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টা পরেই রাশিয়া ওডেসার সমুদ্র বন্দরে ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আক্রমণ করে। যা এই পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ জাগায়। যদিও বড় রপ্তানি টার্মিনালগুলো বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবুও বন্দর ও উপকূলীয় পানিতে মাইন এর ভয় এখনো বিদ্যমান। সব মিলিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ তৈরি করছে একটি ক্ষুধার্ত বিশ্ব।

তথ্যসূত্র

বিবিসি, ব্লুমবার্গ, দ্য কনভারসেশন, দ্য ওয়েস্টার্ন প্রোডিউসার

Comments