ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের ‘বিকল্প’ ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল

আসন্ন শীতে রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। এ অবস্থায় সাময়িক সমাধান হিসেবে প্রায় ২০টি ভাসমান গ্যাস টার্মিনাল চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।
ফরাসি এলএনজি টার্মিনাল 'এলএনজি এনডেভর'। এরকম আরও ২০টি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। ফাইল ছবি: এপি
ফরাসি এলএনজি টার্মিনাল 'এলএনজি এনডেভর'। এরকম আরও ২০টি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। ফাইল ছবি: এপি

আসন্ন শীতে রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। এ অবস্থায় সাময়িক সমাধান হিসেবে প্রায় ২০টি ভাসমান গ্যাস টার্মিনাল চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।

আজ বুধবার বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই টার্মিনালগুলো অন্যান্য দেশ থেকে তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) নিয়ে আসবে এবং তা ঘরবাড়ি গরম রাখার জন্য ব্যবহৃত জ্বালানিতে রূপান্তর করবে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এসব ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

এদিকে এই উদ্যোগের দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম নিয়ে ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা সতর্ক করে বলছেন, টার্মিনালগুলো দীর্ঘমেয়াদে এলএনজির ওপর ইউরোপের নির্ভরতা বাড়াবে। এই গ্যাস তৈরি, তা পরিবহন ও পোড়ানোর সময় মিথেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটিয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা, এই ধারা চালু হলে তা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

ইউরোপের চাহিদা অনুযায়ী এলএনজির চালানের বেশিরভাগ আসবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পর ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। এর আগে ইউরোপের সামগ্রিক জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশই আসত রাশিয়া থেকে। 

ম্যাসাচুসেটস প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী জন স্টারম্যান বলেন, 'এত বড় আকারের এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণের অর্থ হচ্ছে সারা বিশ্বের জীবাশ্ম ভিত্তিক জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা অব্যাহত থাকবে, যা প্রকারান্তরে আগামী কয়েক দশক ধরে জলবায়ুর ক্ষতি করতে থাকবে।'

ইউরোপের দেশগুলো বছরের পর বছর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে সোচ্চার হলেও রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এই ২০টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালকে তাদের বন্দরে ভিড়তে দেওয়ার জন্য রাজি হয়েছে।

অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী যুক্তি দেন, এই বড় আকারের জাহাজগুলো নির্মাণ করতে যে খরচ হবে (জাহাজ/টার্মিনাল প্রতি ৫০০ মিলিয়ন ডলার), তা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাত ও প্রচলিত জ্বালানি উৎপাদনকেন্দ্রগুলোর উপযোগিতা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা উচিৎ।

মার্কিন এলএনজি উৎপাদন কেন্দ্র ভেঞ্চার গ্লোবাল এলএনজি। ছবি: এপি
মার্কিন এলএনজি উৎপাদন কেন্দ্র ভেঞ্চার গ্লোবাল এলএনজি। ছবি: এপি

স্টারম্যান যুক্তি দেন, সৌরবিদ্যুৎ বা উইন্ডমিল নির্মাণ করে রাতারাতি রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প তৈরি হবে না। তবে যথেষ্ট পরিমাণ তহবিল পাওয়া গেলে বাড়ি, দালান ও কারখানায় জ্বালানি ব্যবহারে আরও উপযোগিতার চর্চা এবং সৌর ও বায়ুকল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব।

গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার গ্যাসের সবচেয়ে বড় ভোক্তা দেশ জার্মানি ২০টির মধ্যে ৫টি টার্মিনাল নিয়মিত ব্যবহার করবে এবং এই খাতে তারা ইতোমধ্যে ৩ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে। এছাড়াও, দেশটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত একটি আইনের পরিবর্তন করেছে, যাতে ন্যুনতম সময়ে দেশটিতে এই টার্মিনালগুলো চালু করা যেতে পারে।

এই উদ্যোগেও পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

জার্মান সরকারের পাশাপাশি জ্বালানি খাতের প্রতিনিধিদের ভাষ্য, তারা রাশিয়া থেকে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে এলএনজি টার্মিনালের অনুমোদন দিয়েছেন।

গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের বিশ্লেষক গ্রেগ অ্যাইটকেন উল্লেখ করেন, পোল্যান্ডের গানস্কতে শিগগির একটি এলএনজি টার্মিনালের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।

গ্রেগ আরও জানান, এই টার্মিনালের সঙ্গে মার্কিন এলএনজি সরবরাহকারীদের চুক্তির মেয়াদ অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত।

জ্বালানি বিশ্লেষক আইরা জোসেফ জানান, রাশিয়ার গ্যাস বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় কপাল খুলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি উৎপাদকদের। নতুন ৩টি রপ্তানি টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে এবং আরও ১১টি নতুন টার্মিনাল তৈরি ও ৪টি টার্মিনাল সম্প্রসারণের কাজ পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। কিছু রপ্তানি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকলেও সম্প্রতি তারা নতুন করে অর্থায়ন পাচ্ছে।

আমেরিকার একটি এলএনজি উৎপাদন কেন্দ্রে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে। ছবি: এপি
আমেরিকার একটি এলএনজি উৎপাদন কেন্দ্রে সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলছে। ছবি: এপি

ইউরোপে গ্যাসের সঙ্কটে বিশ্বব্যাপী এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। চীনসহ এলএনজির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করছে।

জ্বালানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্টাদের একজন বিশ্লেষক জানান, আগামী ১ বছরে মার্কিন এলএনজি রপ্তানির পরিমাণ ১০ মিলিয়ন টন বাড়বে।

ভাসমান টার্মিনালগুলো একবার নির্মাণের পর পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে এলএনজি নিয়ে যেতে পারবে। সুতরাং ইউক্রেন যুদ্ধ শেষে ইউরোপের দেশগুলো আর এলএনজি না কিনলেও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে এই জ্বালানির বাজার খুঁজে পাবে।

স্টারম্যান বলেন, 'যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমাদের সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু সে সময় কেউ বলবে না, চলুন আমরা এগুলোকে (ভাসমান টার্মিনাল) ধ্বংস করে ফেলি। তারা সেটি করবেন না।'

 

Comments