গারবাতেল্লার সেই মেয়েটি

১৯৯২ সালের জুলাই মাস। ১৫ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী রোমের কট্টোর ডানপন্থী ছাত্র আন্দোলন যুব ফ্রন্টের স্থানীয় কার্যালয়ের ডোরবেল বাজান। তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো। ভেতরে অনেক নেতা ছিলেন। তারা এই স্কুলছাত্রীকে দেখে অবাক হন। কারণ তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের আবেদন করেছেন। শুরুতে তাকে তেমন পাত্তা দেওয়া হলো না।
জর্জিয়া মেলোনি। ছবি: রয়টার্স

১৯৯২ সালের জুলাই মাস। ১৫ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী রোমের কট্টোর ডানপন্থী ছাত্র আন্দোলন যুব ফ্রন্টের স্থানীয় কার্যালয়ের ডোরবেল বাজান। তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো। ভেতরে অনেক নেতা ছিলেন। তারা এই স্কুলছাত্রীকে দেখে অবাক হন। কারণ তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের আবেদন করেছেন। শুরুতে তাকে তেমন পাত্তা দেওয়া হলো না।

কিন্তু, ধীরে ধীরে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। সেই মেয়েটি সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে শুরু করে। একের পর এক নেতৃত্বে সাহসী ভূমিকা রাখায় ইতালির রাজনীতিতে উত্থান হয় তার।

বলছিলাম ৩০ বছর আগের কথা। তখনকার সেই স্কুলছাত্রী ছিলেন জর্জিয়া মেলোনি। যিনি ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। ইতালির নির্বাচনে ডানপন্থী জোটের প্রধান তিনি। ইতালির রোববারের নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে।

জর্জিয়া মেলোনি। ছবি: রয়টার্স

যদি মেলনির ফ্রাতেল্লি দি' ইতালিয়া বা ব্রাদার্স অব ইতালি পার্টি রোববারের ভোটের ফলে সবচেয়ে বড় অংশ দখল করে তবে এটি নিশ্চিত ইতালির রাজনীনিতে চমক আসতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে নতুন সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। যেমন- ইতালির অর্থনৈতিক ড্যাশবোর্ডের সতর্কতা লাইটগুলো জ্বলজ্বল করছে, কারণ ইউরোপ মন্দার প্রান্তে আছে। আবার ইইউ সীমান্তে যুদ্ধ চলছে।

ইতালি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সেই দেশের নেতা হিসেবে মেলনিকে এই সংকটগুলো মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

তবে, এসব কিছু ছাপিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো কে এই জর্জিয়া মেলোনি, তার মূল্যবোধ কী, তিনি কোথা থেকে এসেছেন…

এসব প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও রোমের যুব ফ্রন্টের তার প্রথম দিকের বন্ধু এবং মিত্রদের কাছে আছে। সেই দলটির অনেক সদস্যই এখন ব্রাদার্স অব ইতালির সিনিয়র ব্যক্তিত্ব। কেউ কেউ দেশ পরিচালনায় মেলোনির সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত।

১৯৯২ সালের সেই গ্রীষ্মের দিনে মেলোনিকে কট্টর ডানপন্থী বলে মনে হয়েছিল। যদিও তিনি রোমের শ্রমিক-শ্রেণির এলাকা গারবাতেল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। আর গারবাতেল্লা ছিল কট্টর বামপন্থী এলাকা। তার এলাকার স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বামপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

তিনি জাতীয় জোটের যুব শাখার সভাপতি ছিলেন, এটি একটি দল যা মোভিমেন্তো সোশিয়ালে ইতালিয়ানোর (এমএসআই) থেকে গড়ে উঠেছিল। ইতালির ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠার আগে বেরলুসকোনির ২০০৮-২০১১ সালের সরকারে যুবমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মেলোনি।

মেলোনির নিজস্ব বিবরণ অনুযায়ী, যে ঘটনাটি তাকে যুব ফ্রন্টে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল তা হলো মাফিয়া-বিরোধী প্রসিকিউটর পাওলো বোরসেলিনোর হত্যাকাণ্ড। কিন্তু তার সহযোদ্ধাদের মতে, এ কারণে তাদের যে দায়বদ্ধতা দৃঢ় হয়েছিল তা ছিল দেশপ্রেম এবং আন্দোলনের প্রতি আবেগ।

মেলোনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'আমি জর্জিয়া। আমার শিকড়ই আমার ধারণা।'

মেলোনি দাবি করেন, বামপন্থী শিক্ষকরা তার চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষাকে এক ধরনের রাজনৈতিক শো ট্রায়ালে পরিণত করেছিলেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

সমসাময়িকভাবে যুব ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন নিকোলা প্রোকাকিনি। তিনি বলেন, 'স্পষ্টতই তখন আমরা বিদ্রোহী ছিলাম, কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বামপন্থী ছিল। তাদের সবকিছু আজকের মতো ছিল, যদিও বর্তমানে আরও খারাপ হয়েছে... এতে আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা কমেছে।'

যুব ফ্রন্ট গ্রুপের স্থানীয় শাখা 'দ্য সিগালস' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। রিচার্ড বাখের উপন্যাস 'জোনাথন লিভিংস্টোন সিগাল' লেখার পরে। সিগালদের অনেকেরই পারিবারিক জীবন জটিল ছিল এবং মেলোনির দৃষ্টিতে তারা বিকল্প পরিবার খুঁজছিল। মেলোনির বাবা তাদের পরিবারকেও ত্যাগ করেছিলেন।

প্রোকাকিনি স্মরণ করেন, সিগালের সদস্যপদ পার্ট-টাইমারদের জন্য ছিল না। আমাদের ছিল ভয়ানক অভিজ্ঞতা, যেটি আমাদের পুরো জীবন দখল করে নিয়েছিল। একবার এক অনুষ্ঠানে অ্যাক্টিভিস্টদের ফোন বই দেখে রাজনীতির বাইরে বন্ধুদের কল করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ফোন বইয়ে এমন কারো নম্বর ছিল না, যে বা যারা আমাদের রাজনীতির বাইরে ছিলেন।

এই দলটি বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, যার ফলে প্রায়ই তাদের আহত হতে হয়েছে। জিওভানবাত্তিস্তা ফাজোলারি যিনি এখন একজন সিনেটর এবং মেলোনির অন্যতম ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'আমাদের প্রজন্মের সবাইকে কিছুদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হাত ভেঙেছিল। এটি তখন আমাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।'

প্রোকাকিনি বলেন, অ্যাক্টিভিস্টরা নারীদের রক্ষার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মেলোনি তখনো বিশেষ চিকিৎসা নেননি।

যাই হোক ইতালির রাজনৈতিক স্থানটি এখন 'ডান' দিকে মোড় নিতে প্রস্তুত। কারণ ডানপন্থী নেতা জর্জিয়া মেলোনি পরবর্তী এবং প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন।

রোববার অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনে মেলোনির ব্রাদার্স অব ইতালি শীর্ষস্থান দখল করেছে বলে প্রথম এক্সিট পোলে উল্লেখ করা হয়েছে। দলটি ২২ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় সম্প্রচারক আরএআই।

তার ডানপন্থী জোটের মিত্র মাত্তেও সালভিনির অতি-ডানপন্থী লিগ পার্টি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকনির ফোরজা ইতালিয়া পার্লামেন্টে উভয়কক্ষে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে বলে আগে থেকেই আশা করা হয়েছিল।

২১ জুলাই মারিও দ্রাগি জোট সরকারের একটি মিত্র দল ব্যবসা ও পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক প্যাকেজ সমর্থন করতে অস্বীকার করার পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগের পর এই নির্বাচনের আহ্বান জানানো হয়।

মেলনির ব্রাদার্স অব ইতালি (এফডিআই) পার্টির উৎস মোভিমেন্তো সোশিয়ালে ইতালিয়ানো (এমএসআই)। যেটি বেনিতো মুসোলিনির শাসনামলে জর্জিও আলমিরান্টে গড়ে তুলেছিলেন।

এফডিআই একটি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। যে জোটটি সরকার গঠনে প্রস্তুত। ওই জোট সরকার ও ইতালির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন ৪৫ বছর বয়সী মেলোনি।

এর আগে, গত বছর দ্রাগির 'জাতীয় ঐক্য' সরকারে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন মেলোনি। যা ঘটনাক্রমে তার দলের জন্য আর্শীবাদ হয়ে এসেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, গণ অভিবাসনের বিষয়ে মেলোনির কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তিনি গর্ভপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী এবং সমকামী বিয়ে ও প্যারেন্টিংয়ের বিপক্ষে তার অবস্থান।

গত জুনে মারবেলা ভ্রমণ করেন জর্জিয়া মেলোনি। তিনি সেখানে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, প্রাকৃতিক পরিবারের জন্য এলজিবিটি লবিকে না।'

তিনি ইউরোপীয় আইনের চেয়ে ইতালীয় আইনকে অগ্রাধিকার দিতে ইতালির সংবিধান সংশোধনের কথাও বলছেন। মেলোনি ইতালীয় রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় প্রথম নারী হিসেবে শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হবেন।

নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, 'জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, ভোট। আসুন আমরা নতুন ইতালির স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।'

সূত্র: রয়টার্স, পলিটিকো, আরআইএ, ডিপ্লোম্যাট

Comments