যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইরানের তুলনামূলক সামরিক শক্তি

২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সোলাইমানি নিহতের পর নতুন করে তিক্ততায় রূপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক। বেড়ে যায় দেশ দুটির সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা। এরপর থেকেই দেশ দুটির সামরিক শক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে নানান বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক আলোচনা।

২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সোলাইমানি নিহতের পর নতুন করে তিক্ততায় রূপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক। বেড়ে যায় দেশ দুটির সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা। এরপর থেকেই দেশ দুটির সামরিক শক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে নানান বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক আলোচনা।

চলতি বছরের পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী সামরিক শক্তিতে বিশ্বের ১৪২টি দেশের মধ্যে আমেরিকার অবস্থান প্রথম ও ইরানের অবস্থান ১৪তম।

কয়েকটি ক্যাটাগরি আলাদাভাবে দেখলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সামরিক শক্তির বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। যেমন-

জনবল

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ লাখ ৩৫ হাজার ৩৯৮ জন মানুষ নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় জনবহুল দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৫ জন মানুষের ইরান বিশ্বের ১৮তম জনবহুল রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে জনসংখ্যার ব্যবধান প্রায় ২৫ কোটি।

যুক্তরাষ্ট্রে এই জনসংখ্যার মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ১৪ কোটি ৭৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৯৫ জনের। ইরানে এই সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯০ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বয়সে পৌঁছায় ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৭৯ জন, যা বিশ্বের পঞ্চম। ইরানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ২২৩ জন, যা ১৬তম।

সেনাবাহিনীতে সক্রিয় সদস্য সংখ্যার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আছে ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ জন এবং অবস্থান তৃতীয়। অন্যদিকে ইরানের সেনাবাহিনীতে সক্রীয় সেনার সংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার এবং এ তালিতায় বিশ্বে অবস্থান সপ্তম।

তবে রিজার্ভ সেনা সদস্যের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ৪ লাখ ৪২ হাজার এবং বিশ্বে অবস্থান দশমঅ অন্যদিকে ইরানের রিজার্ভ সেনা সদস্যের সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার এবং বিশ্বে অবস্থান ১২তম।

যুক্তরাষ্ট্রে আধা সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য না থাকলেও ইরানের ৯০ হাজার সদস্য রয়েছে। যা বৈশ্বিক বিবেচনায় ২২তম।

আর্থিক অবস্থা

বিশ্বে প্রতিরক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ খাতে বাজেটের পরিমাণ ৭ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করে বিশ্বে ৪৪তম অবস্থানে রয়েছে ইরান।

বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। তাদের ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ডলার এবং এ ক্ষেত্রে বিশ্বে তাদের অবস্থান ১৪০তম। তবে ইরান এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। দেশটির বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা বিশ্বে ৩৩তম।

জ্বালানি ক্রয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয় ও ইরানের অবস্থান ২২তম।

আকাশ প্রতিরক্ষা

যুদ্ধবিমানের সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বে প্রথম। দেশটির ১৩ হাজার ২৪৩টি যুদ্ধবিমান রয়েছে। অন্যদিকে ৫৪৩টি যুদ্ধ বিমান নিয়ে বিশ্বে ২২তম অবস্থানে রয়েছে ইরান।

পাশাপাশি ১ হাজার ৯৫৭টি জঙ্গি বিমান নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ১৯৭ জঙ্গি বিমান নিয়ে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম।

বিমান হামলা বা ডেডিকেটেড অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথম। অন্যদিকে ইরানের অবস্থান ২০তম।

সামরিক পরিবহনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আছে ৯৮২টি উড়োজাহাজ। অন্যদিকে ইরানের আছে ৮৫টি।

প্রশিক্ষক, বিশেষ অভিযান, হেলিকপ্টার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ২ হাজার ৬৬১টি প্রশিক্ষণ বিমান এর বিপরীতে ইরানের আছে ৯৬টি।

স্পেশাল মিশন এয়ারক্রাফ্টের দিক দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথম, অন্যদিকে ইরানের অবস্থান নবম।

যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যা যথাক্রমে ৫ হাজার ৪৬৩টি ও ৯১০টি। অন্যদিকে ইরানের আছে যথাক্রমে ১২৬ ও ১২টি।

স্থল শক্তি

ট্যাংক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের বেশ পার্থক্য রয়েছে। ৬ হাজার ৬১২টি ট্যাংক নিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয় এবং ২ হাজার ৮৩১টি ট্যাংক নিয়ে ইরানের অবস্থান দশম।

অস্ত্রসজ্জিত যানের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আছে ৪৫ হাজার ১৯৩টি এবং ইরানের আছে ৭ হাজার ৬০০টি।

তবে সেল্ফ-প্রোপেলড আর্টিলারির ক্ষেত্রে ২ দেশের অবস্থান কাছাকাছি। চতুর্থ স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আর্টিলারি ১ হাজার ৪৯৮টি এবং সপ্তম স্থানে থাকা ইরানের আছে ১ হাজার ৩০টি।

টোয়েড আর্টিলারির দিক থেকে এগিয়ে ইরান। র‍্যাংকে ৬ নম্বরে থাকা ইরানের আছে ২ হাজার ১০৮টি এবং আমেরিকার আছে ১ হাজার ৩৩৯টি।

মোবাইল রকেট প্রজেক্টরের ক্ষেত্রেও এগিয়ে ইরান। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইরানের ২ হাজার ৪৮৫টি প্রজেক্টরের বিপরীতে চতুর্থ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রজেক্টর ১ হাজার ৩৬৬টি।

নৌ শক্তি

যুদ্ধ জাহাজের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। ৪৮৪টি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ১৪২টি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে  ইরানের অবস্থান ২১তম।

যুদ্ধ বিমান বহনকারী জাহাজ, হেলো ক্যারিয়ার ও ডেসট্রয়ারের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আছে ১১টি যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজ, ৯টি হেলো ক্যারিয়ার ও ৯২ ডেসট্রয়ার। এসবের কোনোটাই নেই ইরানের কাছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৬৮ সাবমেরিনের বিপরীতে ইরানের আছে ১৯টি। সাবমেরিনের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তৃতীয় ও ইরানের অবস্থান সপ্তম।

তবে ৭ ছোট যুদ্ধজাহাজ বা ফ্রিগেটস নিয়ে র‍্যাংকে দশম অবস্থানে থাকা ইরানের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিগেটের সংখ্যা শূন্য।

২২টি করভেট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ এবং ৩টি নিয়ে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে ইরান।

পেট্রোল ভেসেলসে এগিয়ে ইরান। দেশটির ৬৬ ভেসেলের বিপরীতে (র‍্যাংক ১৩) যুক্তরাষ্ট্রের আছে ১০টি (র‌্যাংক ৪৮তম)।

তবে, বিভিন্ন ধরনের মাইনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ইরান। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ১৪তম এবং ইরানের অবস্থান ২১তম৷

লজিস্টিকস

এয়ারপোর্টের সংখ্যায় শীর্ষস্থানে থাকা আমেরিকার ১৩ হাজার ৫১৩টির বিপরীতে ২১তম অবস্থানে থাকা ইরানের আছে মাত্র ৩১৯টি এয়ারপোর্ট।

মার্চেন্ট মেরিনেও এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির মার্চেন্ট মেরিনের সংখ্যা ৩ হাজার ৬২৭টি (ষষ্ঠ) অন্যদিকে ২০তম অবস্থানে থাকা ইরানের আছে ৮৯৩টি।

বন্দর ও টার্মিনালের সংখ্যাতেও এগিয়ে আমেরিকা। বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আছে ৩৫টি বন্দর ও টার্মিনাল। অন্যদিকে ৪টি নিয়ে ১৭তম অবস্থানে রয়েছে ইরান।

শ্রমশক্তিতে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে থাকা আমেরিকায় রয়েছে ১৪ কোটি ৬১ লাখ ২৮ হাজার মানুষ। এর বিপরীতে ১৮তম অবস্থানে থাকা ইরানের আছে ৩ কোটি ৫ লাখ মানুষ।

তেল সম্পদ

তেল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিনের ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেলের বিপরীতে ইরানের উৎপাদন ৪২ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল। এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ৬ষ্ঠ।

প্রুভেন অয়েল রিজার্ভের ক্ষেত্রে এগিয়ে ইরান। বিশ্বে চতুর্থ স্থানে থাকা ইরানের প্রুভেন রিজার্ভ ১৫ হাজার ৭২০ কোটি ব্যারেল। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ৩ হাজার ৫০০ কোটি ব্যারেল প্রুভেন রিজার্ভ নিয়ে বিশ্বে ১১তম অবস্থানে আছে।

ভৌগোলিক অবস্থান

আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তৃতীয়। এর আয়তন ৯৮ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৫ বর্গ কিলোমিটার। ইরানের আয়তন ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ কিলোমিটার (১৭তম)।

তবে অন্য দেশের সঙ্গে সীমানা থাকার ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ইরান। বিশ্বে ১০২তম অবস্থানে থাকা ইরানের অন্য দেশের সঙ্গে সীমানার পরিমাণ ৫ হাজার ৮৯৪ কিলোমিটার। যুক্তরাষ্ট্রের আছে ১২ হাজার ৪৮ কিলোমিটার।

যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় সীমানা আছে ১৯ হাজার ৯২৪ কিলোমিটার এবং বিশ্বে এর অবস্থান ৯৭তম। অন্যদিকে ইরানের উপকূলীয় সীমানা আছে ২ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার এবং বিশ্বে অবস্থান ৬৪তম।

জলপথের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আছে বেশ বড় ব্যবধানে। পঞ্চম অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ৪১ হাজার ৯ কিলোমিটার জলপথের বিপরীতে ৬৫তম অবস্থানে থাকা মরু দেশ ইরানের আছে ৮৫০ কিলোমিটার জলপথ।

সার্বিক বিচারে অল্প কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ইরানের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বেশ এগিয়ে ও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।

সূত্র: গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার, আমর্ডফোর্সেসডটএইউ, ইন্ডিয়া নিউজ টুডে ও দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

7h ago