গিটার কাঁদতে জানে

কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’-সহ অসংখ্য গানের গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে লিখলেন দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে।
Shibli with Bachchu
প্রয়াত ব্যান্ডসংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু এবং লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী। ছবি: সংগৃহীত

কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’-সহ অসংখ্য গানের গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে লিখলেন দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে।

আমি জীবন থেকে লিখি। তাই লেখায় আমাকে খুব বেশি রঙ মেশাতে হয় না। অনেক দিন আগে জেমস ভাইয়ের জন্য একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেখানে লিড গিটারের ছয়টি তারের আলাদা করে ছয়টি দুঃখবাদী নাম দিয়েছিলাম, সেই তারের নামগুলো ছিল: একা, চিরদুঃখী, অভিমানী, অশ্রু, স্মৃতি ও পরবাসী। যদিও মূল গানে ব্যবহার করা হয়েছে চারটি নাম। গানটার নাম ছিল: ‘গিটার কাঁদতে জানে’।

ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে

ছয় রকমের কষ্ট আমার,

ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের মতো

নির্ঘুম রাত জেগে জেগে

গিটার কাঁদতে জানে।

অভিমানী একটি তারের

নীল চোখের মতো

চিরদুঃখী একটি তারের

বুকটা জমাট ক্ষত।

অশ্রু নামের একটি তারের

নীরব ভাষার কাছে

স্মৃতি নামের তারের ছোঁয়ায়

আগুন হয়ে নাচে।

একা নামের একটি তারের

সুখের একটু পাশে

পরবাসী তারটি বড়

বিষাদ ভালোবাসে।

 

দেশের তিনজন বিখ্যাত গিটারিস্ট বাচ্চু ভাই, জেমস ভাই আর নীলয় দার সঙ্গে আমার ছিল আত্মার সম্পর্ক। আমি কত অগণিত রাত-দিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের বাজানো দেখেছি। জিমি হ্যান্ড্রিক্স, জো স্যাট্রিয়ানি, কার্লস স্যান্টানা, ডেভিড গিলমোর, গ্যারি মুর ও মার্টি ফ্রেডম্যানের মতো বিশ্ববিখ্যাত গিটারিস্টদের কম্পোজিশন শুনতে শুনতে গিটার বোঝার কানটা তৈরি হয়েছিল বলেই বুঝতে পারতাম দেশে আমাদের এই তিন গিটারিস্ট কোন উচ্চতায় আছেন। তাই আমার মনের গভীরে এক সম্মানের জায়গায় তোলা আছে এই তিনজনের নাম।

জেমস ভাইয়ের জন্য কবিতাটা লেখার সময় গিটার যন্ত্রটাকে আমার রক্তমাংসের সংবেদনশীল মানুষের মতোই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল ছয়টি দুঃখবাদী অনুভূতিকে টোকা দিয়ে অশ্রুপাত করানো সম্ভব। নীলয় দার কলাবাগানের বাড়িতে বহুবার তাকে আমি গিটারে কান্না বাজাতে দেখেছি। বাচ্চু ভাইয়ের রয়েছে এমন বহু সিগনেচার কান্নার পিছ, যেমন ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, আর ‘কেউ সুখী নয়’ গানের লিড পার্টটা কান্না ছাড়া আর কিছুই না। এই দুটি পিছ তৈরি হয়েছে আমার সামনে। ‘কেউ সুখী নয়’-এর সুরটা তৈরি হয়েছিল নির্জন অন্ধকার ছাদে, যেখানে আমি, বাচ্চু ভাই এবং তার গিটার ছাড়া জাগতিক আর কিছু ছিল না। তার সেই কান্নার সুরটা আমার স্পর্শ করেছিল বলেই আমি লিখতে পেরেছিলাম ‘আসলে কেউ সুখী নয়’।

সবশেষে একদম আক্ষরিক অর্থেই দেখলাম কীভাবে জেমস ভাই গিটারে কান্না বাজায়। বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর বরগুনার কনসার্টে শোকে বিহ্বল জেমস ভাই লুকানো কান্নাটা যেভাবে গিটারের ভেতর দিয়ে বের করেছেন, সেটাকে আমি সাম্প্রতিক সময়ের বেস্ট গিটার কম্পোজিশন হিসেবে আখ্যা দিতে চাই। আমি চাই জেমস ভাইয়ের সেই প্লেইংটা আগামী প্রজন্মের জন্য আর্কাইভে সংরক্ষণ করে রাখতে।

নিন্দুকেরা যে যা-ই বলুক, আমি জানি জেমস ভাই বাচ্চু ভাইকে কতটা ভালোবাসতেন। ছেলেমানুষিতে তারা ছিলেন আমাদের চোখে টম অ্যান্ড জেরির মতো। দূর থেকে দেখলে তাদের এই সম্পর্ককে অনেকে ভুল বুঝতে পারেন, কিন্তু আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি আমাদের সংগীতের এই দুই বরপুত্রের সম্পর্কের রসায়নটা কোন মাত্রায় ছিল। তাদের মধ্যে ভালোবাসার বাইরে যেটা ছিল সেটা ‘প্রতিযোগিতা’। আমার কাছে এই সম্পর্কের তুলনা যেমন রোমান গ্র্যান্ডমাস্টার রাফায়েল আর মিকাঞ্জেলো। এদের পরস্পরের ঈর্ষা ছিল জগদ্বিখ্যাত, আর সেই ঈর্ষার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে কত অমর সৃষ্টি। বাচ্চু ভাই ও জেমস ভাই পরস্পরকে তাদের সেরা কাজ দিয়ে অতিক্রম করতে চাইতেন। সেই প্রতিযোগিতায় লাভবান হয়েছে দেশের লাখ লাখ সংগীত পিপাসু তরুণ শ্রোতা আর লাভবান হয়েছে বাংলা সংগীত। আমার চোখে এই দেশে এখন পর্যন্ত কমপ্লিট রকস্টার মাত্র দু’জন। একজন আইয়ুব বাচ্চু আর একজন জেমস। এই দুজন ফ্যাশন আর লাইফ স্টাইলে নিজেদের আইকনে পরিণত করতে পেরেছেন। বাচ্চু ভাই ও জেমস ভাই একই সময়ে হাত ধরাধরি করে চলেছেন সমান্তরাল, অথচ ভিন্ন পথে। এই ভিন্নতার কারণে তাদের তুলনা করা চলে না। যেমন তুলনা চলে না রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মধ্যে। এখন ভাবলে অবাক লাগে, পুরো নব্বই দশকজুড়ে এই দুই রক আইকন বেড়ে উঠেছেন বলতে গেলে একই ছাদের নিচে।

ফিলিংস আর এলআরবির চার চারজন করে আটজন আর আমরা যারা তাদের সঙ্গে কাজ করেছি সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ জনের একটা পরিবার, যেখানে অবধারিতভাবে অভিভাবক ছিলেন বাচ্চু ভাই। অ্যালবাম ক্যাপসুল আর স্ক্রু-ড্রাইভার এখনো ধারণ করে আছে সেই পারিবারিক ইতিহাস। বাচ্চু ভাই জেমস ভাইকে আদর করে ডাকতেন ‘জিমি’ আর জেমস ভাই ডাকতেন ‘বুড়ো’ বলে।

এই জিমি আর বুড়োর ভালোবাসা খুনসুটি, ঈর্ষার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়ে গেছে বাংলাদেশের রক মিউজিকের ইতিহাসের একটা অধ্যায়। এজন্য আইয়ুব বাচ্চুর জীবন নিয়ে কথা বললে অবধারিতভাবেই উঠে আসবে জেমস ভাইয়ের কথা আর জেমস ভাইকে নিয়ে কথা বললে উঠবে বাচ্চু ভাইয়ের কথা।

অনেকদিন আগে আমি একবার জেমস ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাচ্চু ভাইকে আপনার কেমন গিটারিস্ট মনে হয়?”

জেমস ভাই সিরিয়াস গলায় বলেছিলেন, “হি ইজ এ ন্যাচারাল বর্নড গিটারিস্ট।”

তাদের দুজনার বিষয়ে আমারও তাই মনে হয়। তারা স্বাধীন বুনো প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা, বাপে খেদানো আর বাড়ি পালানো কিশোর। গানের টানে একজন রাজশাহী থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে, আর একজন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। ভাগ্যিস তারা প্রচলিত জীবন আর ক্যারিয়ার থেকে পালিয়েছিলেন, নইলে বাংলা গানের এই বিপ্লবটা কীভাবে হতো!

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে হুলিয়া মাথায় নিয়ে নাটোর থেকে আমিও পালিয়ে এসেছিলাম এই শহরে। ভাগ্য আমাদের এক লক্ষ্যে মিলিয়েছিল। নব্বই দশকজুড়ে আমি এই দুই রকস্টারের জন্য সমান তালে লিখেছি, একজনের জন্য ‘জেল থেকে বলছি’, আর একজনের ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’-সহ আরো অনেক গীতিকবিতা, যেগুলো তাদের জাদুকরী কণ্ঠ আর কম্পোজিশনের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে গেছে সারাবিশ্বের অগণিত বাংলাভাষীর হৃদয়ে। তাই একজন আইয়ুব বাচ্চুর থাকা না থাকায় কী আসে-যায়, একদিন কেউই আমরা থাকব না, হয়তো আমাদের সেসব কথা আর তাদের গিটারের কান্নাগুলো বেঁচে থাকবে আরো অনেক অনেক দিন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

7h ago