এবি কিচেনে রান্না করা অসংখ্য গান, সুর ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে

AB Kitchen
কিংবদন্তি ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে লেখক (বামে)। ছবি: সংগৃহীত

আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে সাংবাদিকতার সূত্রে প্রথম পরিচয়। সেই আইয়ুব বাচ্চু কীভাবে ‘বস’ হয়ে উঠলেন, গিটার ইনস্টিটিউটের স্বপ্নের কথা, তার গানে কেন কষ্টের কথা বেশি থাকে, এবি কিচেনে রান্না হওয়া গানের কথা বিষয়ে অনেক কথা লিখেছেন সাংবাদিক, গীতকবি- এম এস রানা

প্রতিভারা সবসময় জন্মায় না, সবখানে জন্মায় না। যুগ যুগ পর, শত বছর কিংবা সহস্র বছর পর পর আসেন। আইয়ুব বাচ্চুর মতো একজন অসাধারণ গিটার প্রতিভা আমরা পেয়েছিলাম। তার কতটা কদর আমরা করতে পেরেছি, আর তার কাছ থেকে কতটা নিতে পেরেছি সেটা সময়ই বলে দেবে। এটাও নিশ্চিত, তার অভাবটা সংগীতপ্রিয় মানুষকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে, আর তার সংস্পর্শ পাওয়া মানুষেরা তাকে নিয়ে আমরণ স্মৃতিকাতর হবেন...

হয়ে ওঠা ‘বস’

তখন সাংবাদিকতার শুরুর দিক। ভয়ে ভয়ে বাচ্চু ভাইয়ের সামনে যাই। স্টুডিওতে গিয়ে দেখি সবাই তাকে ‘বস’ বলে সম্বোধন করেন। দ্বিধায় পড়ে যাই। কী নামে সম্বোধন করব? সাংবাদিক হয়ে একজন শিল্পীকে ‘বস’ বলে ডাকব? দিন গড়ায়। অবাক হয়ে দেখি! প্রতিটা মানুষের সঙ্গে কী বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন আইয়ুব বাচ্চু! পূর্বসূরীদের সশ্রদ্ধ সম্মান প্রদর্শন করেন। আশপাশের মানুষগুলোকে ছায়ার মতো আগলে রাখেন। পরিচিতজন, বন্ধুজন, শিল্পী, গীতিকার এমনকি সাংবাদিক, ছোট-বড় সবার ব্যক্তিজীবনেরও খোঁজখবর নেন। সান্তনা দেন। সহযোগিতা করেন। রাগ করেন। অভিমান করেন। আবার রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে নিজেই ফোন করে খোঁজ নেন। আর এভাবেই তিনি নিজগুণে হয়ে ওঠেন সবার ‘বস’। কখনো মিউজিশিয়ান হিসেবে, কখনো শিল্পী হিসেবে, কখনো বন্ধু হিসেবে, কখনো বা ভাই হিসেবে।

মনেতে লুকানো ছিল ইনস্টিটিউটের স্বপ্ন

২০০৩ সালের কথা। পাক্ষিক আনন্দভুবনে গিটার শেখার একটি বিভাগ শুরুর পরিকল্পনা করছি। আর গিটার মানেই তো আইয়ুব বাচ্চু। এক সন্ধ্যায় বাচ্চু ভাইয়ের ‘রান্নাঘরে’ মিটিং। পুরো পরিকল্পনাটা শুনে তিনি চরম উচ্ছ্বসিত। বললেন, “দারুণ একটা ব্যাপার হবে তো! আমার দেশের তরুণরা ব্যান্ডের গান শুনছে, নিজে নিজে গিটার বাজানোর চেষ্টা করছে, শেখানোর কেউ নেই। তেমন কোনো প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। তোর উদ্যোগটাকে আমি স্যালুট জানাই। আমার শতভাগ শুভকামনা আর সহযোগিতা থাকবে।”

বললাম, “বাচ্চু ভাই, লেসনগুলো তো আপনাকেই দিতে হবে! গিটার তো আপনি শেখাবেন!” স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আমাকে মাফ করে দে। আমি নিজের নামে লেসন দিতে চাই না। আমি ছোটখাটো গিটারবাদক! আরও কত কত শিল্পী আছেন তাদের নিয়ে কর।” বললাম, “রাগ করে বলছেন? নাকি অভিমান? আপনি যা জানেন, সেটা নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে যাবেন না?” একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি, “একটা বাস্তব কথা বলি, পত্রিকার প্রতিটা কলাম ইঞ্চির দাম আছে। সেখানে বিনা টাকায় কতদিন গিটার শেখানোর মতো একটা অপ্রচলিত কাজ মালিকপক্ষ চালিয়ে যাবেন, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। মাঝপথে হুট করে বন্ধ করে দিলে বদনামটা আমার হবে। কষ্টটা আমি পাব।”

বাচ্চু ভাইয়ের চোখ দুটো কেমন ছলছল হয়ে উঠল। দুজনেই চুপচাপ। পরিবেশটা কেমন গুমট হয়ে উঠল। আনমনে কিছু একটা ভাবলেন। বললেন, “আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমি একটা ইনস্টিটিউট গড়তে চাই। এখানে মানুষ গিটার শিখবে, গিটার চিনবে, গিটার জানবে। প্র্যাকটিস করবে, মিউজিক নিয়ে গবেষণা করবে, দেশ-বিদেশের বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে। আমি নিজেও কষ্ট করে গিটার শিখেছি। তাই নতুনদের জন্য গিটার শেখার একটা প্লাটফর্ম করে দিতে চাই।” বললাম, “এ তো ভালো কথা। কিন্তু পরিকল্পনা কতদূর এগিয়েছে?” বাচ্চু ভাই বললেন, “এখনো পরিকল্পনা গোছাচ্ছি। ভালো ইনভেস্টর পেলেই শুরু করব। টেনশন কেবল ইনভেস্টর নিয়েই।”

এরপর ২০০৯ সাল। সমকালের একটা ফিচার করতে গিয়ে আবারো প্রসঙ্গটা তুললাম। কতদূর এগোলো ইনস্টিটিউটের কাজ? জানালেন, “ইনভেস্টর পাইনি। আর আমি নিজেও জীবিকার তাগিদে নানান কাজে ব্যস্ত। তাই বেশিদূর এগোয়নি।”

২০১৭ সালে বিটিভির একটা অনুষ্ঠানের কাজ করতে গিয়ে আড্ডার ছলে আবারো কথাটা পাড়লাম। বাচ্চু ভাই হাসলেন। বললেন, “এখনো হয়নি রে। তবে বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন হয়ে যাবে। আসলে এদেশের মানুষ ভাতের হোটেলে ইনভেস্ট করতে চায় কিন্তু গিটার শেখানোর জন্য না। তরুণদের নিয়ে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চেয়েও তো করতে পারলাম না। সেই দুঃখে তো গিটারগুলোই নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম!”

২০১৮ সাল। বাচ্চু ভাই চলে গেলেন। ইনস্টিটিউট আর হলো না।

কথা অল্প, কষ্ট বেশি

আইয়ুব বাচ্চুর বেশিরভাগ গানেই ‘কষ্ট’ ব্যাপারটা স্পষ্ট। ‘কষ্ট’ নিয়ে তো আস্ত একটা অ্যালবামই করে ফেললেন। দিন-তারিখ মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, এক সন্ধ্যায় এবি কিচেন থেকে তার গাড়িতে চড়িয়ে অফিসে নামিয়ে দিলেন। পথে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা বস, আপনার গানে এত কষ্ট কেন?” হাসলেন তিনি, বললেন, “প্রতিটি মানুষই তো কষ্টবিলাসী। মানুষ কষ্ট পেতে ভালোবাসে। তাই মানুষের কষ্টগুলোই আমার গানে থাকে।”

বাচ্চু ভাই চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আসলেই কি তাই? আমি জানি, কোনো কিছুই জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। শিল্পীর জীবনের অনেকটাই তার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি! আসলেই কি মানুষের কষ্টের কথা বলেন? নাকি আপনার ব্যক্তিজীবনে কোনো কষ্ট আছে?”

শব্দ করে হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, “সবার জীবনেই কষ্ট থাকে। বাদ দে ওসব কথা। অন্য কথা বল।”

আর কোনো কথা সেদিন বলা হয়নি। বাকি পথটা নীরবেই কাটল।

অন্যের সুরে জীবনের শেষ গান

জীবনের শেষভাগে আর অন্যের সুরে গান করতে চাইতেন না আইয়ুব বাচ্চু। শেষমেশ করলেন। বলা চলে এটাই তার জীবনের শেষ গান, যেটা তিনি অন্যের সুরে গেয়েছেন, অন্যের লেখায় কণ্ঠ দিয়েছেন। ‘ছায়াশরীরী’ নামের মিক্সড অ্যালবামের টাইটেল গান এটি। যদিও গানটিতে আইয়ুব বাচ্চুকে পুরোপুরি স্বাচ্ছন্দ্য মনে হয়নি। গানটির জন্য তিনি যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। গানটির পেছনের একটা দীর্ঘ ঘটনা রয়েছে। সুরকার জিয়া খান দীর্ঘদিন আইয়ুব বাচ্চুর পিছু লেগেছিলেন একটি গান করবেন বলে। আমাকে বললেন, “বাচ্চু ভাইয়ের জন্য একটা গান লিখে দেন।” কিন্তু, বাচ্চু ভাই রাজি হন না। জিয়াও ছাড়ার পাত্র নন। “যা গাইব, তবে এটাই শেষ! নয় বছর পর আবার অন্যের সুরে গাইছি,” রাজি হলেন তিনি। হাসতে হাসতে বললেন, “খেয়াল রাখিস, অনেক করে বলেছিস তাই গাইলাম। আমার কোনো অসম্মান যেন না হয়। তবে এটাই কিন্তু শেষ।” গান রিলিজ হলো। শেখ মঞ্জু সেই গানের একটা চমৎকার ভিডিও বানালেন। বাচ্চু ভাই সেখানেও ধৈর্য নিয়ে সময় দিলেন। কে জানত সত্যিই ‘ছায়াশরীরী’ হবে আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের শেষ গান, অন্যের সুরে, অন্যের কথায়! এর সংগীতায়োজন করেছিলেন চিরকুট ব্যান্ডের পাভেল অরিন। গানটি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

এবি কিচেন

মগবাজার কাজী অফিসের গলি। বিনোদন জগতের সবার কাছে এই ‘মগবাজার কাজী অফিসের গলি’ মানেই আইয়ুব বাচ্চুর গানের স্টুডিও। নাম এবি কিচেন। আইয়ুব বাচ্চুর জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে এই স্টুডিওতে। এলআরবি কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর অসংখ্য জনপ্রিয় গানের আঁতুড়ঘর এটি। ‘আইয়ুব বাচ্চুর রান্নাঘর’। তার সঙ্গে মিটিং মানেই এবি কিচেন। ইন্টারভিউর জন্য ফোন করতেই বলতেন, “কিচেনে চলে আয়।”

নতুন কোনো মিউজিক হবে, এবি কিচেন। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডাবাজি তো এবি কিচেন। বাচ্চু ভাইয়ের মন খারাপ তো এবি কিচেন। ঘুম থেকে জেগেই চলে আসতেন ‘কিচেনে’। সারাদিন, কখনো কখনো সারাটা রাত কাটত এই ‘কিচেনে’। মন খারাপ কিংবা মন ভালো, সামনে শো আছে কিংবা হাতে কাজ নেই, যে কোনো পরিস্থিতিতেই তার আশ্রয় এই কিচেনের প্র্যাকটিস রুম। গিটারের ছয়টি তারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৌড়ে বেড়াত আঙুলগুলো। থরে থরে সাজানো তার শখের সব গিটার।

এক সন্ধ্যায় কিচেনে বসে কথা হচ্ছিল। জানতে চাইলাম, “আচ্ছা বস, আপনার স্টুডিওর নাম কিচেন কেন?” হেসে বললেন, “এখানে তো দিন-রাত রান্নাবান্না করি। গানের রান্না।” বললাম, “তাহলে তো এর রেসিপিও থাকা উচিত?” বললেন, “আছে তো- লিরিক পরিমাণ মতো, মিউজিক মনের মতো, মানে গিটার, কিবোর্ড, অর্কেস্ট্রা, ড্রামস ইত্যাদি। এরপর পরিমাণমতো মিক্স মাস্টারিং। হয়ে গেল গানের রান্না। এভাবেই দিন-রাত রান্নাবান্না করে নিজের গান নিজেই খাই, স্বাদ নিই,” কথা শেষ করেই শিশুর মতো হাসতে লাগলেন।

এবি কিচেনে এখন আর চুলো জ্বলে না। রান্না হয় না আর কোনো গান। থরে থরে সাজানো গিটারগুলো এখন স্থির, বাক্সবন্দি। আর সেই ঘরে ‘রান্না করা’ অসংখ্য গান, অসংখ্য সুর ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে।

Comments

The Daily Star  | English

Portfolios of 7 advisers redistributed in major shakeup

Sk Bashir Uddin gets commerce, textile ministries; Farooki gets cultural affairs ministry

2h ago