‘আমরা ভীষণ মর্মাহত’

শুকরানা মাহফিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাহফিলের প্রধান অতিথি। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী সভাপতি। জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (বামে), অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন (মাঝে) ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

শুকরানা মাহফিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাহফিলের প্রধান অতিথি। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী সভাপতি। জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত।

এ বিষয়ে আজ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এটি হচ্ছে এক ধরনের আপোষ। যা অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা এরা যে দাবি করছে, এই দাবি তো বাড়তে থাকবে। এর মধ্যেই অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। ওদের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনটি খুবই ক্ষতিকর। এটা খুবই আপত্তিকর। পাকিস্তান আমলেও এ ধরনের কাজ হলে আমরা প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে এটা হয়ে গেল, কিন্তু আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারলাম না।’

তিনি বলেন, ‘আজকের পর থেকে ওরা যে ক্ষমতা দেখাবে, তাতে ওদের দাবির তালিকা আরও বাড়িয়ে ফেলবে। এরা তো অনেক কিছু চাইবে, শেষে প্রতিক্রিয়া দেখানোও শুরু করবে। কাজেই এটি তো একেবারেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সরকার কীভাবে এদের ছাড় দিচ্ছে, সেটি ভেবে আমরা ভীষণ মর্মাহত।’

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টিকে আমি নেতিবাচকভাবেই দেখছি। রাজনৈতিক সমাবেশের কারণে নির্ধারিত পাবলিক পরীক্ষা যদি পিছিয়ে দেওয়া হয়, সেটিকে তো আমি ভালো চোখে দেখব না। আর একটি সমস্যা হলো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ ধরনের সমাবেশ করলে জনগণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, ভীতিকর যানজটের সৃষ্টি হয়, সেটিকে আমি মোটেও ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখছি না। সমাবেশের তারিখটি অন্য কোন সময়ে দিলেই ভালো হতো, একটি পাবলিক পরীক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক করে নয়।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘হেফাজতের সুপারিশ অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ হলো, সেটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাওয়ার শক্ত প্রমাণ বলে আমি মনে করি। আমি শুরু থেকেই পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এসেছি। হেফাজতের নির্দেশেই যে পরিবর্তন হলো সেটি বোঝা গেল, কিন্তু কীভাবে এই পরিবর্তন হলো সেটি জনগণকে জানতে দেওয়া হলো না। অন্তরালবর্তী একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী চক্রপক্ষ এই সিদ্ধান্ত দিলেন, গোটা ব্যাপারটিই হলো লোকচক্ষুর অন্তরালে।’

ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সাধারণ শিক্ষার ডিগ্রির সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো, সেটিকে আমি বর্জন করি। এখানে যা করা উচিত ছিল, কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম সাধারণ শিক্ষার সমমানের কি না, তা যাচাই করা। বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার পরেই এ ধরনের সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। গোটা ব্যাপারটিই আমার কাছে মনে হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। হেফাজতে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী সংগঠন। তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কৌশলগত হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বলছে যে, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনোদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না।’

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘সভা-সমাবেশের অধিকার সবারই আছে। তার সঙ্গে এটাও আছে, রুটিন ব্যাহত না করে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে নিরিবিলি পরীক্ষা দেবে। আমরা যারা শিক্ষাকর্মী তারা সবসময় একটা অনুরোধ করে আসছি যে, রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা যেই হোক না কেন, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের তারা যেন জড়িত না করে, তাদের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়া যেনো ব্যাহত না হয়। নির্বাচনের তো এখনও অনেক দেরি আছে। এখনই এই পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেল, এটি তো আরেক উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই ধারা যদি চলতে থাকে, তা আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই ক্ষতিকর সতর্কবার্তা। এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘পরীক্ষার দিন তো ছয় মাস আগে ঠিক হয়েছে। তারা এই দিনটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না করে কী অন্য কোনো দিন ঠিক করতে পারলেন না? সেটিই তো করা উচিত ছিল। সেটাই যেহেতু তারা করেননি, সেহেতু তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘন করেছেন। নিজেদের অধিকার ফলাতে গিয়ে আরেক জনের অধিকার লঙ্ঘন করা, এটা তো ঠিক না।’

‘প্রায় ২৭ লাখ শিক্ষার্থীর স্বার্থ না দেখে যারা এই এগুলো করেন, তারা কেন করেন বোধগম্য নয়। কার স্বার্থ উদ্ধার হবে? কথা হচ্ছে যে, একদিন পরীক্ষা পেছানো হলে এমন কী বা হবে- কিন্তু এই ধারাটাই তো আনডিজায়ারেবল, এটি মোটেও কাম্য নয়,’ ভাষ্য তার।

হেফাজতের একের পর এক দাবি মেনে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা তো একটি রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি। যারা আজকের এই সমাবেশ করছেন, এটা তাদেরও স্ট্র্যাটেজি, তারা কিছুটা আদায় করবেন। যারাই এগুলো মেনে নিচ্ছেন, রাজনৈতিক দলগুলোই হোক আর যেই হোক, এ সরকারই শুধু না, সব সরকারই এটা করেছেন। তারা ভাবছেন তারাও এখান থেকে কিছুটা আদায় করে নেবেন। দুই পক্ষই কিছুটা আদায়ের ধান্দায় আছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে আমাদের সংবিধানে যে মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলা আছে, সেগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে।’

রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, ‘আমি এটা অস্বীকার করছি না যে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার কোন গুরুত্ব নাই, মূল্য নাই। কিন্তু কোনো কিছু মূল্যায়ন না করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা স্তরকে সাধারণ শিক্ষার সমমানে উন্নীত করা হলো এটা খুবই দুঃখজনক।’

Comments