হেফাজতের সেকাল একাল
(ছবি দুটি দেখতে মাঝের স্লাইডারটি ডানে-বামে টানুন)
শুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। রোববার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তরের স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করায় শুকরানা মাহফিল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে এ উপাধি দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মাহফিলটিতে সভাপতিত্ব করেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী, প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ৯০ দিনেরও কম সময় বাকি থাকতে এই মাহফিল হলো। এর কারণে পূর্ব নির্ধারিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত করে পিছিয়ে দেয় সরকার। মাহফিলের কারণে এর আগে এভাবে মাত্র এক দিন আগে পরীক্ষা স্থগিতের নজীর ছিল না। তবে পরীক্ষা পেছানোর কারণ হিসেবে মাহফিলের কথা উল্লেখ না করে ‘অনিবার্য কারণ’-এর কথা জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই মাহফিলের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীকে কওমি জননী উপাধি দেওয়ার পাশাপাশি কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি আদায়ে সব আলেমকে একত্র করার ক্ষেত্রে অবদান রাখায় হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ারও দাবি উঠে। তবে এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রীকে কওমি জননী উপাধি দিতে গিয়ে গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মুফতি রুহুল আমিন বলেন, আপনি ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর জননীর ভূমিকা পালন করেছেন। আপনাকে আমি এই কওমি সমুদ্রে ঘোষণা করতে চাই, আজ থেকে আপনাকে কওমি জননী উপাধি দিলাম।
তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি রেখে বলেন, আমরা আপনার কাছে দাবি রাখব, বিশেষ করে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম, আমার ভাই সজীব ওয়াজেদ জয় ভাইকেও ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দিয়ে যাবেন।
আর প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের জন্য উপস্থিত আলেমদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি বলেন, দোয়া চাই। সামনে নির্বাচন আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি ইচ্ছা করেন, নিশ্চয়ই আবার তিনি জনগণের খেদমত করার সুযোগ আমাকে দেবেন। …আমার কোনো আফসোস থাকবে না। সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া ও হেফাজতের সঙ্গে সরকারের দৃশ্যমান সখ্যতায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন সামগ্রিক ঘটনায় তারা গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। গোটা ব্যাপারটিই তাদের কাছে মনে হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। বিশেষ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর সরকারের সঙ্গে মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির সখ্যতাকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছেন তারা।
২০১৩ সালের ৫ মে প্রায় ১২ ঘণ্টা অবরোধ করে রেখেছিল হেফাজতের নেতাকর্মীরা। ব্লগারদের নাস্তিক উল্লেখ করে ৮৪ জনের একটি তালিকা করেছিল মাওলানা শফীর হেফাজত। রাজীব,অভিজিতসহ সেই তালিকার অনেকেই পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবি তুললেও সে সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। হেফাজতের ১৩ দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি।
সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই রাজধানীতে তাণ্ডব শুরু করে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। তাদের তাণ্ডব থেকে নারী সাংবাদিকরাও রক্ষা পাননি। রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের ঢাকাছাড়া করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর পর থেকে হেফাজত বলতে শুরু করে তাদের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। ৩,৪১৬ জনকে আসামি করে মোট ৮৩টি মামলা হয়েছিল তখন। গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দেন হেফাজতের সিনিয়র নেতারা।
ঘটনার দিন বিকেলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, হেফাজতের নেতাকর্মীদের অবশ্যই সন্ধ্যার মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে রাজধানী ছাড়তে হবে। তিনি বলেছিলেন, সরকারি সম্পত্তি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর এবং রাজনৈতিক দলের অফিসে হামলা করে হেফাজতে ইসলাম সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। বিএনপি, জামাত ও হেফাজতের উদ্দেশ্য এক-সেদিন এমন কথাও বলেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম প্রথম দৃশ্যমান হয় ২০০৯ সালে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীদের সম অধিকার দিয়ে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করেছিল তারা। এর এক বছর যেতে না যেতেই তারা ফের রাস্তায় নামে। এবার জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা শুরু করে তারা। এর পরই কয়েক বছর বিরতি দিয়ে শাপলা চত্বর অবরুদ্ধ করে হেফাজত।
এই ঘটনার পর সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীও হেফাজতের তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বৈরিতাও কমতে শুরু করে। আর হেফাজতও তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে প্রায় মুখ বন্ধ করে ফেলে। শাপলা চত্বরে তাদের নেতাকর্মীদের ‘নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা চালানো হয়েছে’- শুরুতে এমন প্রচারণায় নামলেও এখন আর সেই প্রসঙ্গটি তুলতে দেখা যায় না হেফাজত নেতাদের।
সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ন্যায়বিচারের প্রতীক থেমিসের মূর্তি নিয়ে আপত্তি তোলে তারা। এক পর্যায়ে মূর্তিটি সরিয়ে নেওয়া হয়। তখনও হেফাজতের দাবির প্রতি নমনীয়তা দেখা গিয়েছিল সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্যতার ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি হচ্ছে এক ধরনের আপোষ। যা অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা এরা যে দাবি করছে, এই দাবি তো বাড়তে থাকবে। এর মধ্যেই অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। ওদের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনটি খুবই ক্ষতিকর। এটা খুবই আপত্তিকর। পাকিস্তান আমলেও এ ধরনের কাজ হলে আমরা প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে এটা হয়ে গেল, কিন্তু আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারলাম না।’
তিনি বলেন, ‘আজকের পর থেকে ওরা যে ক্ষমতা দেখাবে, তাতে ওদের দাবির তালিকা আরও বাড়িয়ে ফেলবে। এরা তো অনেক কিছু চাইবে, শেষে প্রতিক্রিয়া দেখানোও শুরু করবে। কাজেই এটি তো একেবারেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সরকার কীভাবে এদের ছাড় দিচ্ছে, সেটি ভেবে আমরা ভীষণ মর্মাহত।’
ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হেফাজতের সুপারিশ অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ হলো, সেটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাওয়ার শক্ত প্রমাণ বলে আমি মনে করি।’
তিনি মনে করেন, কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম সাধারণ শিক্ষার সমমানের কি না, তা যাচাই করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল।
‘গোটা ব্যাপারটিই আমার কাছে মনে হয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। হেফাজতে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী সংগঠন। তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক কৌশলগত হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বলছে যে, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনোদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না,’ বক্তব্য আনোয়ার হোসেনের।
তবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই হয়ত প্রধানমন্ত্রী শুকরানা মাহফিলে গিয়েছিলেন। আর এটা যে কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশাল রাজনৈতিক প্রাপ্তি, সেটাও মানছেন তিনি।
এই নারী অধিকার নেত্রী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান দেখা যাচ্ছে। যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করে।
তবে এটাকে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন তিনি।
Comments