কেন বিএনপি-আওয়ামী লীগ লবিস্ট নিয়োগ করে?

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে কয়েকটি দেশের প্রশ্ন তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি প্রচুর ‘টাকাপয়সা’ দিয়ে লবিং করাচ্ছে। তার মতে, ‘নির্বাচন নিয়ে অনেকগুলো দেশের সঙ্গে আলোচনা করলে একটি-দুটি দেশ প্রশ্ন তুলতেই পারে। এটা লবিংয়ের মাধ্যমেও হতে পারে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে কয়েকটি দেশের প্রশ্ন তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি প্রচুর ‘টাকাপয়সা’ দিয়ে লবিং করাচ্ছে। তার মতে, ‘নির্বাচন নিয়ে অনেকগুলো দেশের সঙ্গে আলোচনা করলে একটি-দুটি দেশ প্রশ্ন তুলতেই পারে। এটা লবিংয়ের মাধ্যমেও হতে পারে।’

গতকাল (১৮ নভেম্বর) দৈনিক প্রথম আলোর এক খবরে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি। এ জন্য সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার (বর্তমান বিনিময় মূল্যে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা) খরচ করেছে তারা।

শুধু বিএনপিই নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের নীতিগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার চালানো, সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের সপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে অন্তত তিন বছর লবিংয়ের জন্য খরচ করেছে ১২ লাখ ৬০ হাজার ডলার (১০ কোটি ৮ লাখ লাখ টাকা)।

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নথিপত্র পর্যালোচনা করে প্রথম আলো জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ঠেকাতে জামায়াতে ইসলামীও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। এ বিষয়ে আজ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক আমলা আলী ইমাম মজুমদার এবং টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এটি জেনে যারা অবাক হচ্ছে, তাদের অবাক হওয়া দেখেই আমি অবাক হচ্ছি। কেননা আমাদের দেশে তো এখন বাজার অর্থনীতি চালু। বাজার অর্থনীতি বাজার রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। সবকিছুই কেনা-বেচার সামগ্রী হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রমোটার নিয়োগ করা বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মতো রাজনৈতিক কার্যক্রমের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো ঘুষ নেই। কাজ তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয় এটাকে ‘স্পিড মানি’ বলে। রাজনীতিতে যেন-তেন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা টিকে থাকার জন্য ক্যাটারিং সার্ভিস, প্রমোটার ও প্রমোশনাল সেইন্ট নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু, এগুলো তো ভোগবাদের একটি অংশ এবং আধুনিক বাণিজ্যিক কাজকর্মের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে করা হচ্ছে।’

‘বাংলাদেশে এই ধরনের কাজের মুল স্থপতি হল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। আমরা এর জন্য দেশ স্বাধীন করিনি। আমরা এর ঘোরতর বিরোধী। এই অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে রাজনীতিতে এই বাণিজ্যিক চর্চা রুখতে হবে। নির্বাচন তো এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এখান থেকে আমাদের রাজনীতিকে মুক্ত করতে হলে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এই রাজনীতি, সেই অর্থনৈতিক ভিত্তিতে এখনকার অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যে অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল, সেই জায়গায় ফিরে যেতে হবে’ মন্তব্য করেন তিনি।

‘আমরা ঘুণাক্ষরেও এগুলো কল্পনা করি নাই। একাত্তরে আমি এবং আমার মতো লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে দেশকে স্বাধীন করার মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো প্রমোটার নিয়োগ করিনি। মুক্ত এলাকাগুলোতে কোনো দুর্নীতি ছিল না, কোনো নারী নির্যাতন হয়নি, কোনো চুরি-ডাকাতি হয়নি এবং এই ধরনের লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। আমরা সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বিরোধী দলের উপর আস্থার অভাব ও জনগণকে যথাযথভাবে সন্তুষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে না করার জন্য এটি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য এই লবিস্ট দরকার হয়নি।’

‘রাজনৈতিক দলগুলো তো মিটিং, মিছিল, সমাবেশ ও গণসংযোগের মাধ্যমে জনগণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে। লবিস্টের সহায়তা তাদের লাগবে কেন? কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিকতায় সমস্যা আছে। একদিকে নিজেদের উপর আস্থা কম থাকা এবং জনগণকে যেকোনো উপায়ে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য তারা লবিস্ট নিয়োগ করে,’ ভাষ্য তার।

দেশের সুষ্ঠু রাজনৈতিক আবহের জন্য এই সংস্কৃতি ক্ষতিকর উল্লেখ করে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নির্ভরশীল হওয়া উচিত জনগণের মতামতের উপর। কিন্তু, এটি আমলে না নিয়ে তাদের অন্য কিছু করা অনুচিত।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্বের বহু দেশে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং ব্যবসায়িক কৌশলগত লাভের জন্য লবিংয়ের চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত এটি কিছু আইনি পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হয়, যা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে কোনো আইনগত বিধিব্যবস্থা না থাকার সুবাদে এটি গোপন, ষড়যন্ত্রমূলক এবং প্রায় অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনও দেখা যায় যে, নিজেরা একই কাজে সম্পৃক্ত থেকে বিরোধী পক্ষকে এর জন্য অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এটি অনেকটা বাতাসের দিকে থুথু ছোঁড়ার মতো।’

‘লবিংয়ের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কেন দেশের বাইরে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করছে, এটি প্রশ্ন করার মতোই বিষয়। যদি না তারা দেশীয় স্বার্থ পূরণ করার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিস্তার ঘটাতে চায়, কিন্তু এক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই’ মন্তব্য করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জবাবদিহিতার ভিত্তিতে লবিংয়ের বিষয়টি উন্মুক্ত করে দিতে রাজনৈতিক দলগুলো ও নির্বাচন কমিশন মিলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে একটি বৈধ আইনি কাঠামো ঠিক করে নিতে পারে।’

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তারা কেউ-ই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago