পুড়ে যাওয়া স্বপ্ন বাঁচাতে তাজরীনের ১০ শ্রমিকের নিজেদের কারখানা

'তাজরীন আহত শ্রমিক আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই' কারখানায় কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। ছবি: আখলাকুর রহমান আকাশ

তাজরীন ফ্যাশনসের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বপ্নও যেন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। অন্য কারখানায় নানা সময়ে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার ছয় বছর পর সেখান থেকে বেঁচে ফেরা ১০ জন শ্রমিক নিজেরাই কারখানা তৈরি করেছেন। তাদের স্বপ্নের এই কারখানার নাম ‘তাজরীন আহত শ্রমিক আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই’। গত ১ অক্টোবর আশুলিয়ার বুড়িপাড়া এলাকায় তাদের এই কারখানার যাত্রা শুরু হয়েছে।

তৈরি পোশাক কারখানাটিতে যখন আগুন লাগে তখন সেখানে কাজ করছিলেন সবিতা রানী। আহত হয়ে কোনোমতে সেদিন প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি। সবিতা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নের এই কারখানাটির মূল উদ্যোক্তা।

কারখানা স্থাপনের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে সবিতা জানান, আহত হওয়ায় খণ্ডকালীন চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন তারা। কিন্তু কোনো কারখানা ফুল টাইম কর্মী ছাড়া নিয়োগ দিতে রাজি হচ্ছিল না। এর পরই তিনি ছোট পরিসরে একটি কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নিজের এই পরিকল্পনার কথা দগ্ধ অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে জানাতেই আরও নয় জন জুটে যান তার সঙ্গে। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে না আসায় তারা বুঝেছেন নিজের উদ্যোগই এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ তাদের সামনে।

শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে সবিতা জানান, প্রথমে তারা সবাই পাঁচ হাজার করে টাকা জমা করেন। এই টাকা দিয়ে কারখানার জন্য একটি ছোট ঘর ভাড়া নেওয়া হয়। প্রতি মাসে ভাড়া ঠিক হয় চার হাজার টাকা। আর ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয় অগ্রিম হিসেবে। জোগাড় করা বাকি ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মাত্র দুটি সেলাই মেশিন একটি ওভারলক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে তাদের কারখানার যাত্রা শুরু। প্রথম মাসেই ১০ হাজার টাকার কাঁচামাল কিনে পাঁচ হাজার টাকা মুনাফা করেছেন তারা। এছাড়াও তাদের তৈরি করা কিছু পোশাক এখনও অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে।

সবিতার সঙ্গের ৯ জনের মধ্যে আট জন ফ্যাক্টরির নিয়মিত কাজ করেন। আর দুজন ব্যবসার দিকটি সামলাচ্ছেন। শিশুদের পোশাক তৈরি দিয়ে শুরু করলেও এখন তারা আরও বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরির কাজ শুরু করতে চান।

কিন্তু উদ্যোগ শুভ হলেও সবিতা বলছিলেন, এখন তাদের মূল সমস্যা হলো পুঁজির সঙ্কট। এখন সফলতার মুখ দেখতে বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।

কারখানার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবিতা বলছিলেন, ‘আমাদের এখন পাঁচ থেকে সাতটি সেলাই মেশিন ও পুরোপুরিভাবে উৎপাদনে যেতে এক লাখ টাকার পুঁজি দরকার।’

এই উদ্যোগকে এক কথায় প্রশংসনীয় মনে করছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু। কিন্তু আহত এই শ্রমিকদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে অন্যান্যদের সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকেও খাটো করে দেখছেন না তিনি। কারণ এই শ্রমিকদের প্রায় সবাই শারীরিকভাবে পূর্ণ সক্ষমতায় নেই। তাদের অনেকেই শারীরিক অসুবিধার পাশাপাশি মানসিক ও পারিবারিক সমস্যায় ভুগছেন। এক্ষেত্রে সরকার বা গার্মেন্টস মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এগিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন এই শ্রমিক নেতা।

আহত শ্রমিকদের এই কারখানাটিতে কাজ করেন তাজরীনের সাবেক সেলাই মেশিন অপারেটর কর্মী বিলকিস বানু। কারখানায় আগুন লাগার পর তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। এতে প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। কর্মক্ষমতা না থাকায় নিজের ছেলেও তাকে ফেলে চলে যায়। এখন বাঁচার তাগিদেই কাজ করতে হচ্ছে তাকে।

বিলকিস জানান, এখনও পুরোপুরিভাবে কাজ করতে পারেন না তিনি। তার গত কয়েক বছর কেটেছে বিভিন্ন হাসপাতাল আর ক্লিনিক ঘুরে। ২০১৬ সালে তৈরি আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা তহবিল থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি।

নিজেদের ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরুর আগে গত পাঁচ বছর বেকার ছিলেন জরিনা বেগম। তাজরীন কারখানায় আগুন লাগার পর দোতলার জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পিঠে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। কর্মহীন গত পাঁচ বছর তিনি ঢাকার বেসরকারি ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তখন থেকে একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারেন না। দুর্ঘটনার পর পরই স্বামীও ছেড়ে যায় তাকে। চেষ্টা পরও কাজ জোগাড় করতে না পেরে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে ফিরে গিয়েছিলেন। আশুলিয়ায় নিজেদের কারখানা চালু হতেই কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) থেকে আড়াই লাখ টাকা সাহায্য পেয়েছেন জরিনা। এই টাকা দিয়েই গত চার বছর সংসারের খরচের পাশাপাশি তার নিজের চিকিৎসা হয়েছে।

বিলকিস, জরিনা বা সবিতার মতো আর যারা এখানে কাজ করেন তাদের সবার গল্পই প্রায় একই রকম। তাজরীন দুর্ঘটনার পর দেশি ও আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন থেকে তারা যৎসামান্য সহায়তা পেলেও গত পাঁচ বছরে সংসার চালাতে আর চিকিৎসা করতে সে টাকা ফুরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয় বাড়লেও খুব সামান্যই আশার আলো অবশিষ্ট ছিল তাদের। কারণ তাজরীনে তারা এমনভাবে শারীরিক ও মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যে আর অন্য সবার মতো করে তাদের পক্ষে কাজ করা প্রায় অসম্ভব।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাজরীন কারখানায় আগুন লাগে। এই দুর্ঘটনায় ১১৩ জন নিহত ও আরও ১৭২ জন আহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। শ্রমিক পক্ষের দাবি, আগুন লাগায় কারখানাটিতে দুই হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছিলেন। তাই আহতের সংখ্যা অবশ্যই আরও বেশি।

কারখানাটিতে আগুন লাগার সময় সামনের গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শ্রমিকরা। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ বাইরে থেকে গেটটিতে তালা দেওয়ায় ভেতরেই আটকা পড়েন বিশাল সংখ্যক শ্রমিক। প্রাণে বাঁচতে সেদিন অনেককেই কারখানা থেকে লাফ দিতে হয়েছিল।

এই ঘটনায় হওয়া মামলায় কারখানা মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। মামলায় দায়িত্বে অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলাগুলো ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ এ মামলাটি বিচারাধীন।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেলোয়ারকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন আদালত। ছয় মাস পর জামিন নিয়ে সে মুক্ত রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

4h ago