রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রত্যাশা
প্রায় দেড়যুগ সময়কাল পরে দেশের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতার দক্ষিণা বাতাসের আগমন ঘটেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হওয়া সমঝোতার সেই সংলাপ, একটা ইতিবাচক ধারার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে।
২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার আগে থেকেই রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সহিংসতার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। রমনা বটমূল, কোটালীপাড়ায় বোমা, বিচারিক আদালতে বোমা হামলাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ২০০৪ এর আগেই ব্যাপকতা লাভ করেছিল। গ্রেনেড হামলার পর দেশে যে বিভাজন শুরু হলো তারই পথ ধরে লগি-বৈঠা আন্দোলন কিংবা ২০১৪ সালের পেট্রোল বোমার সংস্কৃতির চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর গ্রেনেড হামলা মামলার রায় এলেও লগি-বৈঠা ঘটনায় নিহতদের মামলার রায় হয়েছে কি না তা আমার মতো জাতিও জানে না।
২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শত শত নিরীহ মানুষ আগুনে ঝলসে মৃত্যুবরণ করা এ ভূখণ্ডের মানুষ কোনদিন ভুলবে না। তদন্তের দুর্বলতার কারণে হয়তো ওই সহিংসতার মূল পরিকল্পনাকারীদের কখনোই আমরা চিনতে পারবো না। তবে নৈতিকভাবে ওই ঘটনার জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে দায়ী করা যেতে পারে। যেমনটি ধরে নেওয়া যায় ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার পিছনে প্রশাসনিক সহায়তা ছিল।
রাজনীতিতে যে ইতিবাচক প্রবাহের সম্ভাবনা ড. কামাল হোসেনের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা উদ্যোগী হয়ে সৃষ্টি করেছেন তা কত শক্ত ভিত্তির উপর দাড়াতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সামাজিক ঐক্য সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল শক্তি সংসদের বিরোধী দল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বর্তমান সংসদে বিচিত্র ধারার বিরোধী দলের অস্তিত্ব সংসদীয় গণতন্ত্রকে ম্লান করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকারীদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন ঐক্যের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তার স্থায়িত্ব নির্ভর করবে সংবিধানের দুর্বল বিষয়গুলো ত্রুটিমুক্ত করা। ড. কামালের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলসমূহ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নির্বাচনী ইশতিহারে তুলে ধরেন কি না সেটাও লক্ষ্য করার বিষয়। যেমন: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য থাকা। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামত প্রদানের অধিকার বহুবাদিত্বের পূর্ব শর্ত। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দেশ ভারতীয় সংবিধানের পথ অনুসরণ করা যেতে পারে। তাছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত উচ্চ আদালতে নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ, প্রধান বিচারপতি মনোনয়নে ভারতীয় পদাঙ্ক অনুসরণ করা। সংবিধানের মূল দর্শন হিসেবে নির্ধারিত বিচারিক আদালতের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে উচ্চ আদালতের উপর ন্যস্ত করা। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক পদসমূহে নিরপেক্ষ জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
ভারতের সংবিধান রচনাকারীরা বিভক্ত উপ-মহাদেশেরে মূলঅংশ ভারতীয় সমাজের ঐক্যের প্রয়োজনে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার প্রয়োজনে দিক নির্দেশনা তৈরি করেছিলেন। সেভাবেই আমাদের সামাজিক ঐক্য ধরে রাখতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচারিক আদালত সমূহ সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে মুক্ত করা দরকার। সমঝোতার এ প্রচেষ্টা যদি তা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে নির্বাচনোত্তর সময়ে দক্ষিণা বাতাস উত্তপ্ত মরুবায়ুতে পরিণত হবে।
মনোয়ারুল হক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Comments