মনোনয়ন বাতিল: দুর্ভোগের খণ্ডচিত্র

অদ্ভুত কিছু কারণে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। শুরুতেই কথা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী এডভোকেট জিয়াউদ্দিন জিয়ার সঙ্গে। তার অভিযোগ, মনোনয়নপত্রে আসনের নামের বানানে ভুল থাকার কারণ দেখিয়ে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ভবনে আট বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা বুথে প্রার্থীদের আপিল গ্রহণ করা হচ্ছে। ছবি: রাশেদ সুমন

দেশে নির্বাচনী হাওয়া বেশ জোর গতিতেই বইছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর এবার আপিল আবেদন পর্ব চলছে। গতকাল সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম আগামী বুধবার পর্যন্ত চলবে। এরপর, আগামী ৬,৭ ও ৮ ডিসেম্বর আপিলগুলোর শুনানি করে রায় দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আজ (৪ ডিসেম্বর) সকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবন প্রাঙ্গণে গিয়েই দেখা গেল, বড় বড় ফাইলে নানান কাগজ-পত্র সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীরা। সেখানে আট বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা বুথে প্রার্থীদের আপিল গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশেই গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়। অনেকেই কথা বলছেন প্রার্থীদের সঙ্গে। জানতে চাইছেন- মনোনয়নপত্র বাতিল হলো কেনো? আপিল করেই ক্ষান্ত দেবেন না পরবর্তীতে আদালতে যাবেন?

জানা গেলো, অদ্ভুত কিছু কারণে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। শুরুতেই কথা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী এডভোকেট জিয়াউদ্দিন জিয়ার সঙ্গে। তার অভিযোগ, মনোনয়নপত্রে আসনের নামের বানান ভুল থাকার কারণ দেখিয়ে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।

শেরপুর-৩ আসনে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) প্রার্থী আবুবকর সিদ্দিক বলেন, নতুন ব্যাংক একাউন্ট নেই। এই কারণে তার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। অভিযোগের সুরে বললেন, প্রার্থী হওয়ার জন্য নতুন ব্যাংক একাউন্ট থাকতে হবে, ইসি থেকে এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি এবং নির্বাচনী আচরণবিধিতেও বিষয়টি উল্লেখ ছিল না।

আপিল আবেদন গ্রহণের বিভিন্ন বুথ ঘুরে জানা গেছে, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকা, আয়কর দাখিল না করা, খেলাপি ঋণ ও আদালতে সাজার বাইরেও প্রার্থীর সই না থাকা, দলীয় প্রত্যয়নপত্র ছাড়া দলের নাম ব্যবহার করা, হলফনামায় তথ্য গোপন করা, সরকারি পরিসেবার বিলখেলাপি হওয়া, অসম্পূর্ণ মনোনয়নপত্রসহ বিভিন্ন কারণে অনেকের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।

পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদারের মনোনয়ন বাতিল হওয়ার তার পক্ষে আপিল করতে এসেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঋণ খেলাপির কারণ দেখিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মক্কেলের মনোনয়ন বাতিল করেছেন। কিন্তু, তিনি যে ঋণ খেলাপির দায় থেকে পুরোপুরি মুক্ত তা গত ১১ নভেম্বরেই ইসি কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছিল। আইনেও আছে যে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগেও ঋণ মুক্ত হলে সে ব্যক্তির মনোনয়ন প্রাপ্তিতে কোনো বাধা থাকে না।

কাগজ-পত্র সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীরা। ছবি: আরাফাত সেতু

আজ সারাদিনে ইসিতে সর্বমোট ২৩৪টি আপিল আবেদন জমা পড়েছে। গতকাল সোমবার প্রথমদিনে ৮৪ জন প্রার্থী আপিল করেন বলে ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়।

এদিকে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা পদে থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। অনেকে পদত্যাগ করলেও পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার চিঠি না থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।

বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী শাজাহানপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সরকার বাদলের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার আজ সকালে আগারগাঁওয়ে ইসি ভবনে এসে তিনি আপিল করেন। এ সময় দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্রের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।’ তিনি জানান, এর আগে ইসি থেকে এমন কোনো সার্কুলার পাননি, যেখানে তাদের পদত্যাগের কথা বলা আছে।

একই আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী হিসেবে গাবতলী উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ মিল্টনের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় তিনিও আপিল করেছেন। তার দাবি, উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেই তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। অপরদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তারা বলছেন, মোরশেদ মিল্টনের পদত্যাগ করার কোনো কাগজপত্র তারা পাননি।

ময়মনসিংহ-৮ আসনে (স্বতন্ত্র) প্রার্থী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সুমন মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। তার মনোনয়ন বাতিলের কারণ হিসেবে জানা গেছে, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখাতে পারেননি।

এছাড়াও, লালমনিরহাট-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ না করে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় তার মনোনয়নপত্রটি বাতিল করা হয়েছে। রংপুর-১ আসনে (স্বতন্ত্র) প্রার্থী গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু ও নীলফামারী-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী জলঢাকা পৌরসভার মেয়র ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরীর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায়, আজ তারা আপিল করেছেন।

আইন অনুযায়ী, লাভজনক পদে থেকে নির্বাচন করা যায় না। তবে স্থানীয় সরকারের পদগুলো লাভজনক কি না বা সংসদ নির্বাচন করতে হলে আগে পদত্যাগ করতে হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘একদিকে স্থানীয় সরকারের পদও ছাড়তে হচ্ছে, অপরদিকে সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিতে পারছেন না, এসব প্রার্থীদের সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এই আইন ও পদ্ধতির মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আদালতে গেলে আদালত নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করতে পারেন।’

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে সারা দেশে ৩৯টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মোট ৩ হাজার ৬৫টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। রোববার এসব মনোনয়ন বাছাই করে ২ হাজার ২৭৯ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ বলে বিবেচনা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এর মধ্যে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন তারা।

রোববারই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইসি থেকে বলা হয়, মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীরা সোমবার থেকে আগামী বুধবার (৩ থেকে ৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ইসিতে আপিল করার সুযোগ পাবেন। অপরদিকে, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘কোনো প্রার্থী ইসির সিদ্ধান্তে খুশি না হলে আদালতে যেতে পারবেন।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago