হলফনামার তথ্য, তদন্ত হবে?

Collage

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি ২৪ দিন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে জমা দিয়েছেন প্রার্থীদের নিজের এবং পোষ্যদের সম্পদের বিবরণী। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে অনেক প্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, হলফনামায় কোনো প্রার্থী মিথ্যা তথ্য দিলে কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে হলফনামার তথ্য প্রকাশ করার পরে তা পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করে যদি দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলফনামায় অবৈধ সম্পদের কোনো বিষয় থাকলে তা দুদকের তফসিলভুক্ত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অন্যান্য যেসব সংস্থা সম্পদ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করে তাদের কাছ থেকেও দুদক তথ্য সংগ্রহ করবে।

ইসিতে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে জানা গেছে, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং আগের দুই মেয়াদের হলফনামা অনুযায়ী তার সম্পদ বেড়েছে ৯৩ গুণ। তার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ১২ গুণ। মন্ত্রীর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ১২ হাজার ৯৩৩ টাকা। তার স্ত্রীর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৩ হাজার ৪০৪ টাকা।

যৌথ মালিকানায় এই পরিবহন শ্রমিক নেতার ২ কোটি ৭৫ লাখ ২১ হাজার ৫৩২ টাকার সম্পত্তি রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন শাহজাহান খান। সব মিলিয়ে তার স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা। হলফনামায় তিনি লিখেছেন, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া ভাতার পাশাপাশি ব্যবসা তার আয়ের উৎস। প্রতি বছর ব্যবসা থেকে তার আয় হয় ৩ কোটি ৩৬ লাখ ২ হাজার ২৫০ টাকা। সেই সঙ্গে ভাতা হিসেবে পান ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৮০ টাকা।

২০০৮ সালে শাহজাহান খানের স্থাবর সম্পত্তি ছিলো ৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৫৩ টাকা। তার স্ত্রীর ছিলো ২৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তার অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৫৯ লাখ ১৮ হাজার ৩৪৮ টাকা। তার স্ত্রীর ছিলো ৩৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪৭০ টাকা। এবার শাহজাহান খান তার হলফনামায় অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৩ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭২৪ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৪৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে রাজধানীর পূর্বাচল, মধ্যবাড্ডার আনন্দনগর, লালমাটিয়া, মেরাদিয়ায় রয়েছে নিজের ও তার স্ত্রীর নামে জমি এবং ফ্ল্যাট রয়েছে। ব্যক্তি ও সংস্থা মিলিয়ে ২০০৮ সালে শাহজাহান খানের ঋণ ছিলো ৪৫ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৩ টাকা। তবে এবারের হলফনামায় তিনি ঋণের বিষয়টি উল্লেখ করেননি।

হলফনামা অনুযায়ী, গত ১০ বছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের চেয়ে তার স্ত্রীর আয় বেড়েছে প্রায় ৪৮ গুণ। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মোট অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দেখানো হয়েছে, ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং স্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কামাল তার অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নগদ টাকা দেখিয়েছেন, ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৫ টাকা। অন্যদিকে, তার স্ত্রীর নগদ টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। হলফনামায় আরও বলা হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ১০ ভরি ও তার স্ত্রীর ২০ ভরি সোনা রয়েছে।

বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার এবং শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার টাকা আয় করেন কামাল। চাকরি ও মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া বেতন ও ভাতা ২৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অন্যান্য ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সব মিলে কামালের মোট বার্ষিক আয় ৬৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে, তার স্ত্রীর মোট বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে ব্যবসা থেকে আসে ৪৯ লাখ ২২ হাজার টাকা।

গত ১০ বছরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। কেবল তারই নয়, বেড়েছে তার স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণও। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছিলো ২১ লাখ ৫৭ হাজার ১১ টাকা। এবার সিলেট-৬ আসনের এই প্রার্থী তার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেখিয়েছেন, ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯১১ টাকা। ১০ বছর আগের হলফনামায় তিনি নিজের পেশা উল্লেখ করেছিলেন কৃষি। এবার তিনি পেশা উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক কর্মী। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয়, ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২০৫ টাকা।

তার স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পদ ছিলো ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৪ টাকার। ১০ বছরের ব্যবধানে সেটা ৯ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫৮ লাখ ১৭ হাজার ৩০ টাকা। সেসময় তার কাছে নগদ ৪৭ হাজার টাকা রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছিলো। এবার উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭০৫ টাকা। ব্যাংকে ছিলো ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯৯ টাকা। সেই টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ৯৮৩ টাকা। নুরুল ইসলাম নাহিদের নিজের নামে সঞ্চয়পত্র ছিলো ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৪১২ টাকা এবং আরও ৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৮ টাকা নির্ভরশীলদের নামে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তার নিজের নামে ২০ লাখ এবং স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, বেতন-ভাতা ও অনির্দিষ্ট ব্যবসা থেকে উপার্জনকে নিজের আয়ের উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে এসব উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি তিনি। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের আয়ের ক্ষেত্রেও শেয়ার, ইজারা, বিনিয়োগ এবং বিবিধ উৎস উল্লেখ করা হয়।

হলফনামায় তারা বলেছেন, এরশাদের বাৎসরিক আয় ১ কোটি ৮০ হাজার টাকা এবং রওশন এরশাদের ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এরশাদের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে নিজের নামে বারিধারা, বনানী ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট। অপরদিকে, রওশন এরশাদ উল্লেখ করেছেন তার কাছে ৩৫ কোটি ১ লাখ টাকা নগদ অর্থ রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে এরশাদের ২ কোটি ৩২ লাখ ৪ হাজার ৬৩৫ টাকা ঋণ রয়েছে। যদিও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে তিনি বাৎসরিক বেতন পান ৭৪ লাখ টাকা।

রাজনীতিবিদ অনেকের সম্পদ তার স্ত্রীর চেয়ে কম এমন চিত্রও উঠে এসেছে এবার। গত নির্বাচনে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বন্ড, ঋণপত্র, শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত ছিলো ১২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এবার তিনি হিসাব দেখিয়েছেন, বর্তমানে তার স্থায়ী আমানত রয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর নামে ছিলো ২৭ লাখ টাকা। সেটা দেখানো হয়েছে ৫০ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

কমেছে তার গাড়ির সংখ্যাও। রাশেদ খান মেননের দুটি গাড়ি ছিলো। বর্তমানে রয়েছে একটি। স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে রাজউক পূর্বাচলে তার ৩০ লাখ টাকার জমি, স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার জমি ও ২টি ফ্ল্যাট ছিলো। বর্তমানে রয়েছে ৩৭ লাখ ২০ হাজার টাকার জমি ও স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন এলে দুদক এর পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস পাওয়া যায়। তবে এখন পর্যন্ত সংস্থাটির পক্ষ থেকে কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এই প্রসঙ্গে কথা হয় সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সঙ্গে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সকল কার্যক্রম আইন দ্বারা সিদ্ধ। দুদক চাইলেই কারও বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক প্রথমে অনুসন্ধান করবে। তাতে যদি উঠে আসে অফেন্স হয়েছে- সে ক্ষেত্রে দুদক এজাহার দেবে। দেখতে হবে, বৈধভাবেও সম্পদ বাড়তে পারে। যদি তাই হয়, সে ক্ষেত্রে বলার কিছু থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন ব্যক্তির কাছে নগদ ৫শ টাকা ছিলো। সে তার একটি জমি বিক্রি করায় সেই অর্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার টাকায়। হলফনামায় সম্পদ বৃদ্ধির হিসাব আমরা পাই। এ ক্ষেত্রে যদি সন্দেহজনক মনে হয়, তাহলে দুদক এর উচিৎ একটি অনুসন্ধান নিশ্চিত করা, খতিয়ে দেখা। সম্পদ যে বেড়েছে, সেটা বৈধভাবে না কী অবৈধভাবে। ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে সন্দেহজনক কিছু প্রার্থীর হলফনামা নিয়ে কাজ করা যেতেই পারে।”

তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিবারই নির্বাচনের আগে আমরা সংবাদ দেখি, প্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে এত গুণ। এই সংবাদগুলোকে ‘ঢালাও সংবাদ’ বলা যেতে পারে। এর যদি ফলোআপ রিপোর্ট হয়, গণমাধ্যম যদি তদন্ত করে দেখে ওই ব্যক্তির সম্পদ বৈধ উপায়ে বেড়েছে কী না তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজ অনেক সহজ হবে।”

Comments

The Daily Star  | English

Ex-CEC Nurul Huda gives confessional statement in poll irregularities case

Statement being recorded before magistrate in case over alleged bias in past elections

31m ago