আপিল শুনানিতে যা ঘটলো

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত তিনদিনে ৫৪৩ জনের মনোনয়ন বাতিল আবেদনের উপর শুনানি করে রায় দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
EC Appeal
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে গত ৬ ডিসেম্বর থেকে তিনদিনে ৫৪৩ জনের মনোনয়ন বাতিল আবেদনের উপর শুনানি করে রায় দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত তিনদিনে ৫৪৩ জনের মনোনয়ন বাতিল আবেদনের উপর শুনানি করে রায় দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের ১১তলায় স্থাপিত এজলাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে বিচারক হিসেবে ছিলেন অপর চার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানম ও মাহবুব তালুকদার। তাদের সঙ্গে রায় পড়ে শোনানোর জন্য ছিলেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তাদের সামনে সংক্ষুব্ধ আপিলকারী ও তাদের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। পেছনে থেকে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন গণমাধ্যম কর্মীরা।

প্রথম দিনেই চট্টগ্রাম-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাসিরের আপিল শুনানি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। দুপুরে এই আপিলের শুনানি চলাকালে আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে মীর নাসির নিজে এজলাসে দাড়িয়ে বলেন, দুদকের মামলায় ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছিলেন। এরপর এই মামলাটি পুন-তদন্তে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন আদালত।

ঠিক এই সময় আসন থেকে দাঁড়িয়ে সরকারপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম কমিশনের কাছে আপত্তি জানান এবং কিছু কাগজপত্র দেখান। সঙ্গে সঙ্গেই তানজিবের দাখিল করা দুদকের লিভ টু আপিল দায়েরের তথ্যসহ আরও কিছু তথ্য ভুল বলে জানান মীর নাসিরের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। এই প্রেক্ষিতে খোকন কিছু কাগজপত্রও দেখান। বিষয়টি নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কিছুসময় বাদানুবাদ হয়। এর মধ্যেই ব্যারিস্টার তানজিবুল আলমকে ইঙ্গিত করে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেন, “মাই লর্ড, আচরণ দেখেছেন, একেবারে সরকারী দলের আচরণের মতো আরকি!” অতঃপর কমিশনাররা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে তাদের শান্ত করে মধ্যাহ্ন বিরতিতে যান।

বিরতির পর মীর নাসিরের আপিল আবেদন না-মঞ্জুর বলে ঘোষণা করেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। এ সময় এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম বলেন, “আসামির সাজা বহাল আছে। তিনি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন।” অপরদিকে, বিএনপির আইনজীবীদের দিক থেকে উড়ে আসা কথায় শোনা যায়, “এখানে চিটিং করা হচ্ছে, ওরা সব বাটপার।”

সিলেট-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফয়জুল মুনির চৌধুরীর হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় তার মনোনয়ন বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তার। শুনানি চলাকালে স্বাক্ষরসহ হলফনামা জমা দেওয়ায় তার মনোনয়ন বৈধ বিবেচনা করে কমিশন। এসময় একই অভিযোগে আগেই বাতিল হওয়া হবিগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী মো. জাকির হোসেন দাঁড়িয়ে আপত্তি জানালেও তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেন ইসি সচিব।

গাইবান্ধা-৫ আসনের স্বতন্ত্রপ্রার্থী আবু জাফরের হলফনামায় ১ শতাংশ ভোটারের হিসাবে গরমিল থাকার অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। ৬ ডিসেম্বর বিকালে শুনানিতে অংশ নিয়ে আবু জাফর বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, “কুদ্দুস মরেননি। আমার গ্রামে আল্লাহর রহমতে চার–চারজন কুদ্দুস আছেন। একজন কুদ্দুস মারা গেছেন। ইউএনও সাহেব সেই কুদ্দুসকে আমার সমর্থনকারী ভেবে মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন। আসলে সেই কুদ্দুস আমার কুদ্দুস নন। মৃত কুদ্দুস আমার সমর্থনকারী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ তিনি তো মরে গেছেন। কিন্তু আমার কুদ্দুস মরেননি।” এরপর আবু জাফর বলেন, “এই দেখেন ভিডিও করে ছবি নিয়ে এসেছি। এখন তো ডিজিটাল যুগ।” এরপর ভিডিওতে কুদ্দুসের ছবি দেখালে কমিশন আবু জাফরের আবেদন বৈধ বলে রায় দেন।

নীলফামারী-৪ আসনের প্রার্থী আখতার হোসেন দলীয় মনোনয়ন না পেলেও মনোনয়নপত্রে দলের নাম উল্লেখ করার কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। প্রথম দিনের শুনানিতে আখতার হোসেন বলেন, “স্যার, আমি দলের প্রার্থী হতে চাই। কিন্তু দল আমাকে কোনো চিঠি দেয় নাই। তাই নমিনেশন পেপার বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু নেত্রীর সঙ্গে (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনারা নমিনেশন পেপার ওকে করে দিলে তিনি আমাকে দলীয় চিঠি দিয়ে দেবেন। স্যার, যদি দয়া করেন। নেত্রীর সঙ্গে কিন্তু কথা হয়েছে।” নির্বাচন কমিশনাররা হাসতে হাসতে তার মনোনয়ন বাতিল বলে ঘোষণা করেন।

লালমনিরহাট-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী কালিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম পদ না ছাড়ার কারণে তার মনোনয়ন বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এদিন জাহাঙ্গীরের পক্ষে শুনানি করতে আসেন তার আইনজীবী বগুড়া-৫ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গাইবান্ধার সাবেক জেলা ও দায়রা জজ তাজ মোহাম্মদ শেখ। লাভজনক পদ থেকে পদত্যাগ না করেও প্রার্থী হওয়ার বৈধতা সম্পর্কিত কিছু সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে তিনি এ সময় কমিশনের সামনে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু, কমিশনার রফিকুল ইসলাম তার উদ্দেশ্যে বলেন, এ বিষয়টিতে যুক্তি-তর্কের সময় এখন নেই, এ সংক্রান্ত বিধিমালা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর ইসি সচিব তার আবেদন না-মঞ্জুর ঘোষণা করে পরবর্তী শুনানিতে চলে যান।

নাটোর-২ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তার মনোনয়ন বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। ৬ ডিসেম্বর প্রথম দিনের শুনানিতে কমিশনের সামনে উপস্থিত হয়ে দুলু বলেন, “মোহাম্মদ নাসিম, মায়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, হাজী সেলিম, পঙ্কজ দেবনাথ সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। সেক্ষেত্রে আমিও আপনাদের কাছে সুবিচার চাই। কিন্তু, শুনানি শেষে তার আপিলটি খারিজ করে দেয় কমিশন।

আপিল শুনানির তৃতীয় দিনে (৮ ডিসেম্বর) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ফেনী-১, বগুড়া-৬ এবং বগুড়া-৭ আসনের মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন।

রায় ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, “আমার রায়, আইনগত বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করার পক্ষে প্রদান করলাম।” খালেদার পক্ষে উপস্থিত আইনজীবীরা তখন উল্লাস করে হাততালি দেন।

এসময় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ লাউড স্পিকারে বলতে থাকেন- “এটি ফুল কোর্টের রায় নয়।”

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, “যে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত লোকের মনোনয়ন বিবেচনা করতে পারি না। আমার রায় হলো- এই আপিল মঞ্জুর করা যায় না। নামঞ্জুর করা হলো।” এবার আরেক দল হাততালি দেন।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, সংবিধানের ৬৬ ধারা অনুযায়ী এ আপিল নামঞ্জুর করা হলো।

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, “এখন পর্যন্ত দণ্ড বহাল আছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার অর্ডারে যে বক্তব্য এবং স্পিরিট দেখছি, দণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে আপিল নামঞ্জুর।”

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানম এবং রফিকুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, “দণ্ড বহাল আছে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আমি সে প্রেক্ষিতে আপিল নামঞ্জুর করলাম।”

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ পরে ঘোষণা করেন, “পাঁচজন মাননীয় নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে চারজন আপিল আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। একজন মঞ্জুর করেছেন বিধায় চার-এক ভোটে আপিল আবেদন নামঞ্জুর ঘোষণা করা হলো।”

Comments

The Daily Star  | English

Six state banks asked to cancel contractual appointments of MDs

The Financial Institutions Division (FID) of the finance ministry has recommended that the boards of directors of six state-run banks cancel the contractual appointment of their managing directors and CEOs..The six state-run banks are Sonali Bank, Janata Bank, Agrani Bank, Rupali Bank, BAS

1h ago