‘খেলাপি ঋণ থাকবেই’ ও ‘ব্যাংকাররা ভিলেন’
হতাশা কাটানো এবং আশা জাগানো কিছু কথা শোনা গেল ব্যাংকের এমডিদের মুখ থেকে। ব্যাংক থেকে গত ১০ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি - অনিয়ম- ঋণ জালিয়াতি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এমডিরা জানালেন, এগুলো কিছু ‘ভুল’ ছাড়া বড় কিছু নয়। এসব নিয়ে তারা চিন্তিত নন। জনগণকেও চিন্তামুক্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাত কত বড় অবদান রাখছে, তাও তুলে ধরেছেন এমডিরা। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)’- মাঝেমধ্যে সহায়তা তহবিলে অর্থ দিয়ে থাকেন। চেক তুলে দেওয়ার সময়ের হাসি মুখের ছবি দেখা যায় সংগঠনের নেতৃবৃন্দের। এর বাইরে খুব একটা তাদের দেখা মেলে না। বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা, অর্থমন্ত্রী যেগুলোকে বলেছিলেন ‘পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি’- তখনো এবিবিকে কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। এখন যেভাবে বললেন, তখন যদি তারা বলতেন ‘চিন্তার কিছু নেই’- তাহলে হয়ত অর্থমন্ত্রী নিজে সবচেয়ে বেশি ‘চিন্তামুক্ত’ হতে পারতেন। ‘৪ হাজার কোটি টাকা বড় কোনো ব্যাপার না’- অর্থমন্ত্রীকে ভুল স্বীকার করে এই বক্তব্য হয়ত প্রত্যাহার করে নিতে হতো না।
সিপিডি সম্প্রতি একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। ১০ বছরে ১০টি অনিয়ম- জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংক থেকে লুটপাট হয়ে গেছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এই গবেষণা তথ্যে সংবাদকর্মী হিসেবে অবাক হওয়ার কোনো উপাদান খুঁজে পাইনি। দেশের কোনো মানুষ অবাক হয়েছেন, তাও মনে হয়নি। কারণ সিপিডির গবেষণায় কোনো নতুন তথ্য নেই, যা আছে তার সবই গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। কোনো তথ্যই অজানা নয়, সবই মানুষের জানা। সরাকার বা অর্থমন্ত্রী কোনো তথ্যকেই অসত্য বলেননি, অস্বীকার করেননি। সরকার স্বীকার করে নিয়ে বলেছে ‘যেখানে যা ঘটছে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’।
‘সাগর চুরি’ বলা অর্থমন্ত্রী এখন সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্যকে বলছেন ‘জাস্ট রাবিশ’। ‘রাবিশ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘জঞ্জাল’ বা ‘আবর্জনা’ বা ‘ছাইভস্ম’ বা ‘বাজে বস্তু’। কিন্তু কোনো অর্থ দিয়েই কী বোঝায় যে, সিপিডির তথ্য অসত্য বা মিথ্যা? তাছাড়া জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ‘সাগর চুরি’ বলে কী বুঝিয়েছিলেন? কেনই বা একথা বলেছিলেন?
২.
‘কেন’র উত্তর খোঁজার আগে এবিবি’র কিছু ‘ভুল’ ও ‘চিন্তার কিছু নেই’- বক্তব্য বিষয়ে দুই একটি কথা এবং তথ্য জানা দরকার।
ক. ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ লাখ ৩৭০ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা যা চার গুণেরও বেশি। যদিও এটা প্রকৃত- সঠিক তথ্য নয়। সঠিক তথ্য, এই সময়কালে আর কখনো পাওয়া যাবে না এমন ৩৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন অর্থাৎ হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
খ. সোনালী ব্যাংক এবিবি’র সদস্য, সরকারি মালিকানার জনগণের ব্যাংক। দেশের ছোট -মাঝারি পুঁজির ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ঋণ নিয়ে। মফস্বল পর্যন্ত শাখা বিস্তৃত হওয়ায়ও উপকৃত হয়েছেন তৃণমূলের মানুষ। দেশের অর্থনীতিতে সোনালী ব্যাংকের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু গত ১০ বছরে কী ঘটল সোনালী ব্যাংকে?
সোনালী ব্যাংক এবং হলমার্ক কেলেঙ্কারি যেন পরিপূরক শব্দে পরিণত হয়েছে। এই এক ঋণ জালিয়াতিতেই লোপাট হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বর্তমান এমডি ওবায়েদ উল্লাহ এবিবি’র অনুষ্ঠানে বলেছেন,’...ভাত খেতে গেলে কিছু ভাত পড়তেই পারে। অনেক কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে। খেলাপি ঋণ আছে, থাকবে তবে সেটি মাত্রার মধ্যে রাখতে হবে। ...হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি।’
ঋণের নামে একজনকে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা লোপাটের সুযোগ দেওয়া কি ‘ভুল’? প্লেট থেকে দুই একটি ভাত পড়ে যাওয়ার মতো ‘ভুল’? এক্ষেত্রে কি জনগণের আমানত রক্ষা না করে লোপাটে সহায়তা করার মতো বড় রকমের অপরাধের ঘটনা ঘটেনি?
খেলাপি ঋণের ‘মাত্রা’ কত? বর্তমানে সরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৩২ শতাংশ। ’মাত্রা’র হিসাবে এটাকে সঠিক মনে করছেন সোনালী ব্যাংকের এমডি?
তিনি বলেছেন, ‘৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সাড়ে ২২ হাজার কোটি দেখলে হবে না।’
তার মানে তিনি সিপিডির দেওয়া সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
সোনালী ব্যাংকের এমডি’র এগিয়ে যাওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটি কি খুবই প্রাসঙ্গিক নয় যে, কেন বারবার জনগণের করের অর্থ দিয়ে সোনালী ব্যাংক পরিচালনা করতে হচ্ছে? এক সময় যে সোনালী ব্যাংক অন্য ব্যাংক পরিচালনায় সহায়তা করত, এখন কেন নিজেই চলতে পারছে না? এর নাম ‘হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাওয়া’?
গ. রাজনৈতিক বিবেচনায় জন্মের পরেই ঋণ জালিয়াতির শিকার হয়ে প্রায় দেউলিয়া হতে যাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের এমডিও ‘হতাশ’ না হওয়ার কথা বলেছেন। আমানত লোপাট হয়ে যাওয়ার পর, জনগণের অর্থ দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা ব্যাংকটির এমডি বলেছেন, ‘ঋণ বিতরণ করলে খেলাপি থাকবেই। আমাদের পেছনে ফেরা নয়, বরং সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার’।
সত্যি ‘হতাশা’ দূর করে ‘আশা জাগানো’ জাগানো কথাই বটে!
৩.
২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত লাভজনক বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ শতাংশ। তারপর রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৮০ শতাংশ। সুনির্দিষ্ট তথ্য- উপাত্ত থাকার পরও সেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না, অসহায়ত্বের কথা স্বীকারও করেছেন অর্থমন্ত্রী।
লোপাট হওয়া ভিন্ন ভিন্ন কেলেঙ্কারির কোনো ঘটনার সময়ে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ’কে কথা বলতে দেখা যায়নি। এসব ঘটনা ঘটেনি বা ঘটার কারণ, বা তথ্যগুলো অসত্য বা সত্য, এসব ক্ষেত্রে করণীয় কী, তাদের কিছু করণীয় আছে কিনা- কোনো কথা বলা হয়নি সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
জনতা ব্যাংক যখন একজনকে মোট মূলধনের দ্বিগুণ অর্থ ঋণ দিয়ে দেয়, সেই অর্থ ফেরত না পাওয়ার প্রায় নিশ্চিত আশঙ্কার সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখনো নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় এবিবিকে।
এখন তারা বলছেন, ব্যাংকিং সেক্টর ছোট- বড় ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষম। খুব ভালো কথা। তো ঝুঁকিতে পড়া ব্যাংকগুলোর পাশে আপনারা দাঁড়াচ্ছেন না কেন? কেন জনগণের অর্থ দিয়ে সরকারকে ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে?
আপনারা এত সক্ষম, তো প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া প্রতিশ্রুত সুদের হার ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশ কার্যকর করলেন না কেন?
৪.
ব্যাংকের এমডিরা বলেছেন, ‘ব্যাংকারদের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।’
আসলেই কি তাই? গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বমহল থেকেই ব্যাংকিং সেক্টরের এই অরাজকতায় দায়ী করা হচ্ছে ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ’কে। মূল দায় ব্যাংকারদের ওপর চাপানো হয়নি প্রায় কোনো ঘটনাতেই। কিন্তু ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হওয়া ঘটনাগুলো ‘ভুল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, ঋণ খেলাপির আতঙ্কজনক চিত্রকে স্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করে, সকল দায় কি এবিবি নিজেদের কাঁধে নিজেরাই তুলে নিলেন না? তাহলে কে তাদের ‘ভিলেন’ হিসেবে উপস্থাপন করছে? নিজেদের এই বক্তব্য বা অবস্থানের কারণ কি এমন পরিচিতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে না?
Comments