‘উভয়পক্ষকে মোটেও সমানভাবে দেখা হচ্ছে না’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ১৬ দিন। কিন্তু, এখন পর্যন্ত বিরোধীদের উপর প্রতিপক্ষের হামলার পাশাপাশি পুলিশের মামলা ও গ্রেপ্তারের হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। যদিও সবার জন্য সমান সুযোগের কথাটি বলতে বলতে মুখে খই ফুটিয়ে ফেলা হয়েছে, তথাপি চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়গুলো নিয়ে আজ (১৪ ডিসেম্বর) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এবং ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে যা চলছে, তাতে উভয়পক্ষকে মোটেও সমানভাবে দেখা হচ্ছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-এর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছিলাম, পুলিশ এখন থেকে ইসির নির্দেশ মোতাবেক চলবে এবং নির্বাচনকেন্দ্রীক কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্ষেত্রেই কেবল আটক, গ্রেপ্তার করা হবে।”
“কিন্তু, পরে দেখা গেলো যে, ৯/১০ বছর আগের মামলায় এখনও গ্রেপ্তার চলছে। আমরা চাই দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার হোক। গত ১০ বছর ধরেই ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। অপরাধীদের গ্রেপ্তার যদি করতেই হয়, তাহলে এর আগে না করে এখন কেনো? নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে এই সমস্ত অ্যাকশনের আনন্যাচারাল ইনটেনসিটি কেনো দেখতে পাচ্ছি? এমন প্রশ্ন তো আমরা করতেই পারি।”
“আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি যে, বিরোধীদলের উপর প্রকাশ্যে হামলা হচ্ছে, গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। এসব যারাই করুক, ইসি কেন তৎপর হতে পারছে না? ইসি বলছে, নিজেরা নিজেদের লোকের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে। তাহলে তারা তদন্ত করে তা বের করে আমাদের দেখাক। না হলে আমরা তো ধরেই নিবো, বিরোধীপক্ষ এসব করছে। দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে কী ঘটছে তা জানার অধিকার রয়েছে আমাদের। আমরা এসব অরাজকতা থামাবার জন্য ইসির একটি নিরপেক্ষ অ্যাকশন দেখতে চাই। তা না হলে অবশ্যই আমাদের মনে হতে পারে যে, ইনটেনশনালি বিরোধীদলের জন্য সমতলক্ষেত্র তৈরি করতে দেওয়া হচ্ছে না,” মনে করেন সুলতানা কামাল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, “চলমান সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ইসির কোনো পারঙ্গমতা আমরা দেখতে পাইনি। একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসির এমন অসহায় আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ কিন্তু নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “শুধু যে বিরোধীদের উপরই এসব হচ্ছে তা নয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজনও এর শিকার হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারাভিযান যখন চলছে তখন সবার জন্য সমান সুযোগের কথা শুধু বললেই হবে না, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সংঘর্ষ যেগুলো ঘটছে সেগুলোর দ্রুত তদন্ত করে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।”
“গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তৃতীয় পক্ষের সংশ্লিষ্টতা আছে কী না সেটি খতিয়ে দেখতে। আমরাও মনে করি, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করা, নির্বাচনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করার জন্য অন্য কোনো জায়গা থেকেও অপতৎপরতা থাকতে পারে। পুলিশ ও প্রশাসন যেহেতু ইসির অধীনে পুরোপুরি ন্যস্ত, সেক্ষেত্রে এসব ঘটনায় প্রার্থীদের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদের প্রার্থিতা বাতিল করার মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারে ইসি। সমতলক্ষেত্র তৈরির জন্য ইসিকে অবশ্যই নিরপেক্ষ অ্যাকশনে যেতে হবে,” মত দেন সাবেক এই উপাচার্য।
সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির জন্য ইসির সক্ষমতা রয়েছে কি না?- এমন প্রশ্নের উত্তরে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “ইসির যদি ইচ্ছে থাকে, তাহলে তা না পারার কোনো কারণ নেই। দেশবাসী একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ইসির প্রতি জনসমর্থন রয়েছে। ইসির যেহেতু আইনগত অবস্থান শক্ত সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তারা তা পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, “এমন কিছু তো আমরা কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো লোক এসে অভিযোগও করেনি। আপনাদের কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে তাহলে ভুক্তভোগীদের বলেন যে, নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্য। আমরা প্রতিটি অভিযোগকেই আমলে নেই। আমরা এর তদন্ত করি। অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেই।”
গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে জানালে রফিকুল ইসলাম বলেন, “গণমাধ্যমের খবর আমাদের সতর্ক করে কিন্তু অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কোথায়, কখন, কে হামলা করেছে, কে বা কারা হামলার শিকার হয়েছে, এসবের বিস্তারিত বিবরণসহ অভিযোগ পেলেই আমরা বিষয়টিকে আমলে নিয়ে অ্যাকশনে যাবো।”
নির্বাচনের তো আর বেশিদিন বাকি নেই, লিখিত অভিযোগ না পেলে কি ইসির কোনো করণীয় নেই?- এমন প্রশ্নের উত্তরে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ইসির করণীয় হচ্ছে বিষয়গুলো পুলিশ ও প্রশাসনকে জানানো। আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে যা পারছি তা তাদের জানাচ্ছি। তবে, উনারা সাংসদ হবেন, কিন্তু হামলার শিকার হলে অভিযোগ বা মামলা কিছুই করবেন না। আমরা কি স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে যাবো? এটি কী হয়?”
নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় ইসি কি বিব্রত, মর্মাহত হয়েই ক্ষান্ত, না এসব বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সদিচ্ছা রয়েছে এই সংস্থাটির?- তা জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিব্রত শব্দটি আমি বলিনি। তা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। এ ধরণের ঘটনা যদি ঘটে থাকে, আমরা অবশ্যই সেগুলোকে ভালোভাবে নেবো না। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই পদক্ষেপ নেবো।”
ইসি সচিব সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, “তিনশো আসনের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ১,৮৪৬ জন। কোনো কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। অনেক প্রার্থী ও তার কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে। স্বাভাবিকভাবেই ওয়ান্টেড আসামিদের প্রতি পুলিশের একটি নজরদারি থাকে। এখন যেহেতু আসামিরা প্রচারণায় নেমেছেন, সেক্ষেত্রে ওয়ান্টেড আসামিদের গ্রেপ্তার করার কাজটিও পুলিশের উপর দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়। এখন এদের বাদ দিয়ে যদি প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারেন, তাহলে তো কোনো অসুবিধা নেই।”
বিরোধীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধার সম্মুখীন ও আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগকে কীভাবে দেখছে ইসি?- এই প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, “আমরা গতকালও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনাররা তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে পুলিশ ও প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”
Comments