ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দায়সারা মনোভাব ছিল: মনজুরুল ইসলাম, ভোটদান পদ্ধতির ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে: সাখাওয়াত হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “যেটি সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে, বিরোধী দলের একেবারে সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। তারা অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তাদের কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। কিন্তু, এতো বড় একটা দল যদি এরকম দুর্বলতার ভেতর পড়ে যায়, তাহলে তাদের নির্বাচন করারই বা দরকার কি ছিল?”
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক ও শঙ্কার মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সারাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় ১৯ জনের মৃত্যু, প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারসহ প্রায় দুই শতাধিক আহত এবং আরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। শাসক দলের ভাষ্যমতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও বিরোধীরা এটি প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন।

কেমন হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন?

বিষয়টি নিয়ে আজ (৩১ ডিসেম্বর) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে মতামত জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “এবারের নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি আমি শান্তিপূর্ণই দেখেছি। বিএনপির প্রার্থীরা অনেকে ঘর থেকেই বের হননি। তাদের এজেন্টরাও কেন্দ্রে আসেননি। এর কারণে বোধহয় তাদের সমর্থকরাও আশেপাশে ছিল না। এমনকি আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপির কোনো পোস্টারও দেখিনি। কাজেই যে পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে, বিশেষ করে আমি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছি, সেখানে তো কোনো গোলযোগ বা এমন কিছুই দেখিনি। তবে, এই না দেখা হচ্ছে একটি শান্তিপূর্ণ দিক। কিন্তু, সকলের অংশগ্রহণ তো সেখানে হয়নি।”

“বিএনপির প্রার্থীই যেখানে বের হননি, ভোট দেননি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছি। সেখানে বিএনপির’র প্রার্থী ছিলেন মির্জা আব্বাস। তিনি নিজেও ভোট দেননি। এরকম প্রার্থীদের অনেকেই ভোট না দেওয়ায় তাদের সমর্থকরাও আসেননি। তাতে ভোটটা যেভাবে শুরু হওয়ার কথা ছিল, যেভাবে আমরা সবাই ভেবেছিলাম, খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। সেখানে একেবারে আগে থেকেই এরকম জায়গা ছেড়ে দেওয়া, এই মানষিকতা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি,” মন্তব্য মঞ্জুরুল ইসলামের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, “যেটি সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে, বিরোধী দলের একেবারে সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। তারা অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তাদের কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। কিন্তু, এতো বড় একটা দল যদি এরকম দুর্বলতার ভেতর পড়ে যায়, তাহলে তাদের নির্বাচন করারই বা দরকার কি ছিল? এটাই হলো বড় সমস্যা।”

তিনি বলেন, “এই নির্বাচন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। সন্তুষ্ট হতাম যদি সকলে মিলে শুরু থেকে নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। নির্বাচন তো পাঁচ বছরে একবারই আসে। তো ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দেখলাম দায়সারা একটি মনোভাব। তারা নির্বাচন করছে, কিন্তু কোনো প্রার্থী কোথাও যাচ্ছেন না। কোনো প্রচার নেই, কোনো পোস্টার নেই।”

তিনি আরও বলেন, “এতো বড় একটা দল, যে ২০১৪ সালের পর তারা পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করল, তিনমাস ধরে অবরোধ চালিয়ে গেল, বাসে আগুন দিল, অনেক কিছুই তো করল। তারা হঠাৎ এতো শক্তিহীন হয়ে গেল যে পোস্টার লাগাতেই পারছে না। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে। তখনই আমার মনে হয়েছে যে ভোটটা খুবই একপেশে হয়ে যাচ্ছে। কালকে যখন দুই ঘণ্টার ভেতর তাদের অনেক প্রার্থী বললেন যে ভোট বর্জন করছি, ফলে ভোটারের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।”

“অনেক কেন্দ্রে অনেক নারী ভোটাররা আসেননি। যাই হোক, আমি আরও অংশগ্রহণমূলক, আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চেয়েছিলাম। খেলার মাঠটি আরও সমতল হোক আমি তা চেয়েছিলাম। তবে নানা কারণেই সেটি হয়নি। কিন্তু, নির্বাচন যখন হয়ে গেছে, আমাদের সকলকে তা গ্রহণ করতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে,” মনে করছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নির্বাচন কেমন হলো তা বলে কোনো লাভ নেই, এটি তো হয়ে গেছে। এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকজন কী করবে সেটি তাদের ব্যাপার। আমি ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, পুলিশ ছিল, সব ঠিকই ছিল। সেখানে তো কোনো অনিয়ম দেখা যায়নি। তবে, টেলিভিশন কাভারেজে খুব রেস্ট্রিকটেড দেখলাম। তারপর এখন দেখছি যে, আল-জাজিরা, সিএনএন ও বিবিসিসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বেশ কিছু অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে। আমাদের কয়েকটি মিডিয়াতেও তাই দেখলাম।”

“বিতর্ক ছিল- ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। কখনও একপক্ষ বলেছে যে, নির্দলীয় সরকার দেওয়া উচিত ছিল, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তো এই বিতর্কটি দূর হয়েছে কি না, সেটি হলো বড় প্রশ্ন। যদি দূর না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে যে, আগামী নির্বাচনটি আমরা কোন পদ্ধতিতে করব,” মত দেন তিনি।

অনেক সাধারণ মানুষ ও গ্রামে তার নিজের আত্মীয়-স্বজনেরাও ভোট দিতে পারেননি এমন অভিযোগ থাকার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ভোটদান পদ্ধতির ওপর মানুষ ক্রমান্বয়ে তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। তারপরও তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আমি নিশ্চয়ই তাদের মোবারকবাদ জানাই। সরকার তো তারাই চালাবে কিন্তু একটা জিনিস চিন্তা করতে হবে যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলে আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি।”

“এবার যে ফলাফল হয়েছে, এটা বেশ আশ্চর্য রকম। তাহলে বিএনপির ভোট ব্যাংক কোথায় গেল? এখন বিএনপি বা ঐক্যজোট যে দাবিই করুক না কেন, সেটি নিয়ে তো তথ্য-প্রমাণ হাজির করে বলতে হবে। আমি অনুমানভিত্তিক কোনো কথা বলতে চাই না। এই ধরনের কোনো কিছু হয়ে থাকলে সেগুলো নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় গিয়ে ইসিকে সঠিক তদন্ত করা উচিত,”মন্তব্য করেন তিনি।

সাখাওয়াত মনে করেন, “আমাদের নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া আছে সেটি ঠিক নয়। এখন ভেবে দেখতে হবে, এই প্রক্রিয়ার সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না? তারপর কয়দিনে নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে, সে ব্যাপারটিও ঠিক করতে হবে।”

তার মতে, “প্রতি নির্বাচনের পরেই কেন আমরা সন্দেহ করতে থাকব, কেন আমরা স্বচ্ছ করতে পারিনি, কেন আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হচ্ছে না? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন থাকলেও আমরা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তাকিয়ে আছি, যেখানে সরকারের পূর্ণ সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। আমার মনে হয় যে, সবগুলো বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা উচিত আমাদের সমস্যাগুলো আসলে কোথায় এবং কী ধরনের।”

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago