ডাকসু নির্বাচন হবে, কেমন হবে?

১৯৯০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে আমান উল্লাহ আমান সহ-সভাপতি এবং খায়রুল কবির খোকন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর আগের বছর ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ সহ-সভাপতি এবং মুশতাক আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই প্যানেলটি ছিল ছাত্রলীগসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি যৌথ প্যানেল।
Aparajeyo Bangla

১৯৯০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে আমান উল্লাহ আমান সহ-সভাপতি এবং খায়রুল কবির খোকন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর আগের বছর ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ সহ-সভাপতি এবং মুশতাক আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই প্যানেলটি ছিল ছাত্রলীগসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি যৌথ প্যানেল।

এরপর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু হচ্ছে না ডাকসু নির্বাচন।

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীরা। এ দাবিতে মাঝে-মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও সোচ্চার হতে দেখা গেছে। কিন্তু, বরাবরের মতোই ক্ষমতাসীন সরকারের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ১৭ জানুয়ারি ডাকসু নির্বাচন করতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তারপর ঢাবি কর্তৃপক্ষও নির্বাচনের সুরে কথা বলতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকেও এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়। কিন্তু, প্রশ্ন আসে, ক্যাম্পাসে ডাকসু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, সকল সংগঠনের কর্মী- শিক্ষার্থীদের সহাবস্থানের বিষয়টি নিয়ে?

বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোর বর্তমান চিত্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৯টি আবাসিক হল, চারটি ছাত্রাবাস রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকলেও সবগুলো হল ও ছাত্রাবাস মিলিয়ে ঠাঁই হয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর। বাকি অর্ধেক শিক্ষার্থীর কেউ কেউ নিজস্ব বাসা অথবা বিভিন্ন মেস ও ব্যক্তিমালিকানাধীন হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের মাত্রা এতোই তীব্র হয়েছে যে, হলগুলো বর্তমানে ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ শিক্ষার্থী ধারণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, হাজী মোহাম্মদ মুহসীন হল, কবি জসীমউদ্দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সরেজমিনে ঘুরে ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হলগুলোর চার সিটের প্রায় সব কক্ষেই আট থেকে বারো জন এবং দুই সিটের কক্ষে চার-পাঁচজন অবস্থান করছেন।

আবাসন সংকটের কারণে হলগুলোতে তৈরি হয়েছে ‘গণরুম’। প্রতিটি হলেই চার থেকে ১০টি পর্যন্ত এ ধরনের কক্ষ রয়েছে। চার সিটের এ কক্ষগুলোতে ৩০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী অবস্থান করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাই সাধারণত এ কক্ষগুলোতে থাকেন। হলগুলোর সিট বণ্টনসহ প্রশাসনিক কোনো কার্যক্রমের উপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই। হলে কোন শিক্ষার্থী থাকতে পারবেন, আর কোন শিক্ষার্থী থাকতে পারবেন না, পুরোটার নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে। ছাত্রলীগ যা করে বা করতে চায়, প্রভোস্টসহ প্রশাসন সেটাতেই সায় দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কবি জসীমউদ্দীন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, “প্রথম বর্ষে যখন হলে ওঠার চেষ্টা করি, তখন এক বন্ধু আমাকে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়। তারা আমাকে বলেন যে, ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে হবে- এই শর্তেই আমাকে গণরুমে থাকতে দেওয়া হবে।” তার মতে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হলেই সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ইচ্ছেই শেষ কথা, এই তথ্য কারো অজানা নয়।”

তবে, ছাত্রনেতাদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্রের বর্ণনা পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ছাত্রনেতা চার সিটের কক্ষে একা কিংবা সঙ্গে আরও কয়েকজন নিয়ে থাকছেন। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আসন সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে হলগুলোতে বহিরাগত এবং ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান। এসব বহিরাগতরা ছাত্রনেতাদের আশ্রয়েই হলে থাকেন। অনেক নেতা ‘সিট-বাণিজ্য’ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি হলেই রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা সিটগুলো ভাগ করে নেন। হলগুলোতে বর্তমানে বেশিরভাগ কক্ষই ছাত্রলীগের দখলে রয়েছে।” মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, কবি জসীমউদ্দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছাত্রনেতারা পাশাপাশি কক্ষগুলোতে থাকেন এবং তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বহিরাগতদেরও থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

প্রগতিশীল বাম জোট ও তাবলীগ জামায়াতের মতাদর্শী শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু কক্ষ ছেড়ে দিলেও কোনো হলেই ছাত্রদলের কাউকে থাকতে দিচ্ছে না ছাত্রলীগ। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল, মুহসীন হল, সূর্যসেন হল, শহীদুল্লাহ হলসহ প্রায় সবগুলো হল থেকে শিক্ষার্থীকে মারধর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগের বিষয় সবাই জানেন।

বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী বলেন, “পরিচয় ছাত্রদল এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলেই তাদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। কোনো হলেই ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের উপস্থিতি নেই। ছাত্রলীগ যেভাবে চায়, হল সেভাবেই চলে।”

ছাত্রনেতাদের বক্তব্য

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, “গত ২৮ বছর ধরে ক্ষমতাসীন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে ডাকসু নির্বাচন হয়নি। তবে হঠাৎ করে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের উৎসাহ আমাদের শংকা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এখন পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রগুলো হলে হলে থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু, হলগুলো তো ছাত্রলীগের দখলে চলে গেছে। সম্প্রতি, জাতীয় নির্বাচনে আমরা মানুষের ভোটাধিকার হরণ করতে দেখেছি। এখন ডাকসু নির্বাচনেও যদি হলগুলো ভোটকেন্দ্র হিসেবে থাকে, ডাকসুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। কারণ- গত ১০ জানুয়ারি ডাকসু’র গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মতবিনিময় সভায় আমরা এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছি। কিন্তু, ছাত্রলীগ সেখানে তীব্র বিরোধিতা করেছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ে আদতে কোনো সহাবস্থান নেই উল্লেখ করে উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, “ছাত্রলীগ মুখে মুখে সহাবস্থানের কথা বললেও, তাদের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান নেই। হলগুলোতে বিরোধী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের অবস্থান করতে দেওয়া হয় না। রাজনীতিবিমুখ শিক্ষার্থীদেরও গেস্টরুমে ডেকে নানান হুমকি দেওয়া হয়। ফেসবুকে কে, কার পোস্টে লাইক দিচ্ছে সেগুলোও নজরে রাখা হয়। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ না নিলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলোকে তারা নিজেদের সম্পত্তি মনে করে। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয় না। কারণ- হলগুলোতে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের পক্ষে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।”

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, “সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের পর দেশে সরকারের পালাবদল হলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পেশীশক্তির রাজনীতি চলছে। হলগুলোতে ছাত্রলীগের মতাদর্শের বাইরের কোনো শিক্ষার্থীকে থাকতে দেওয়া হয় না। একটি ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্যের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলের সিট ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় ডাকসু নির্বাচনে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে শংকা তো থাকছেই।”

ছাত্রদলের কোনো নেতা-কর্মী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতে পারেন না। ফলে তাদের সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের প্রাণ বা অক্সিজেন হলো সহাবস্থান। কিন্তু, সহাবস্থান না থাকলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত গঠনতন্ত্র সংশোধন নিয়ে দুটি বৈঠক করেছেন। কিন্তু, সেসব বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমাদের প্রক্টরিয়াল বডির গাড়িতে করে বিশেষ নিরাপত্তায় যেতে হয়েছে। তাহলে সহাবস্থান থাকলো কোথায়?”

তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন হলো রাজনীতি চর্চার পুণ্যভূমি। সকল ছাত্র সংগঠন মধুর ক্যান্টিনে রাজনীতি চর্চার সুযোগ পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো যেভাবে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে ডাকসু নির্বাচন কী করে সম্ভব?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কার্বন-কপি উল্লেখ করে আল মেহেদী তালুকদার বলেন, “যেকোনো স্বৈরাচারী সরকারের জন্য বড় থ্রেট হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে সবাই সচেতন। তারপরও উপাচার্য অবলীলায় বলে যাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান আছে। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি (উপাচার্য) বোধহয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) চেয়েও বড় চমক উপহার দেবেন।”

ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন যে পরিস্থিতি তাতে অবশ্যই ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে। আমরা মনে করি এখনই ডাকসু নির্বাচনের উৎকৃষ্ট সময়।”

‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলের কোথাও সহাবস্থান নেই, প্রতিটি জায়গায় ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিরাজমান’- বিরোধী সংগঠনগুলোর নেতাদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “আমাদের ভালোবেসে কেউ যদি দখল দেয়, সেটিকে কি আপনি দখল বলতে পারেন? কোনো দখলদারিত্বে আমরা বিশ্বাস করি না, কেউ যদি ভালোবেসে তার দখল আমাদের দেয়, সেটি আমরা গ্রহণ করি।”

ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “ছাত্রলীগের মধ্যস্থতায় কাউকে হলে ওঠানো হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষই শিক্ষার্থীদের হলের সিট বরাদ্দ দেয়।”

তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদলের যে কমিটি আছে, সেই সব কমিটির নেতাদের প্রায় সবারই ছাত্রত্ব শেষ। তবে, যাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব আছে তারাই শুধু হলে থাকতে পারবে। এছাড়াও, অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো কর্মী সংকটে আছে, হলগুলোতে তাদের কমিটি নেই। এখন হলে যদি তাদের কর্মী না থাকে, সেই দায় তো আর আমরা নিতে পারবো না।”

ছাত্রলীগের সিট বাণিজ্য, ছাত্রদলের কাউকে হলে পেলেই পিটিয়ে বের করে দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলেন, “এ ধরণের কোনো ঘটনা আমাদের জানা নেই।”

শিক্ষকরা যা ভাবছেন

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “হলের সিট বণ্টনে ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপের বিষয়টি একেবারেই আমাদের জানা নেই। সিট বাণিজ্যের কথা আমি বলতে পারবো না।”

ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে হলে অবস্থানকে অনেক জটিল, দীর্ঘ ও পুরনো সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অনেক সময় চাকরি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত সময় হলে অবস্থান করে। কিন্তু, আমরা নিয়মিত তাদের হল ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছি এবং তাদের কেউ কেউ চলেও যাচ্ছে।”

বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের বহুদিন আগের একটি সিদ্ধান্ত আছে যে, ছাত্র শিবিরের রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিষিদ্ধ। তবে, তাদের পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয় কী না জানি না। ক্রিয়াশীল নয় এরকম ছাত্র সংগঠনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিষিদ্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান করি।”

তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির রাজনীতি বা প্রবেশ দু’টোই নিষেধ। সেক্ষেত্রে ছাত্রদলকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে আমি মনে করি না। যদি তারা বিরোধী শক্তি হয়, সেটি ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু, ছাত্রদলের সদস্যদের হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ সত্য হওয়ার কথা নয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, “অনেকদিন থেকে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না, কিন্তু হওয়াটা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও আগামী দিনের নেতৃত্বের জন্য এটি অত্যাবশ্যকীয়। তবে, ডাকসু নির্বাচনের জন্য সবগুলো সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সবগুলো ছাত্র সংগঠনের সমান অবস্থান আছে কী না, সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা ক্যাম্পাসে ও হলে থাকতে পারে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমগুলোতে সরাসরি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে শংকা ও আতঙ্ক কাজ করে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রথমেই সহাবস্থান নিশ্চিত ও শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন চলাচলের যে শংকা আছে তা দূর করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করেই ডাকসু নির্বাচন করাকে আমি অত্যন্ত প্রয়োজন বলে মনে করি।”

তিনি আরও বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে কমিটি গঠন করেছে, আমি সেটিকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু, আমাদের এখানে একটি বাস্তবতা হচ্ছে যে, সেসব শিক্ষকরা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তারা যদি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও অনুগত থাকেন, তাহলে ডাকসু নির্বাচনের জন্য যে নিরপেক্ষতা প্রয়োজন সেটি ক্ষুণ্ণ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাবো, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ শিক্ষকদের হাতে যেনো এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “সম্প্রতি আমাদের প্রভোস্ট কমিটির একটি সভা হয়েছে। সেই সভায় সহাবস্থানের বিষয়টি নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছি। তাতে ১৯টি হলের সব প্রভোস্ট সর্বসম্মতভাবে একবাক্যে একমত পোষণ করেছেন যে, হলগুলোতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে।”

উপাচার্য বলেন, “আমাদের কাছে সকল সংগঠনের শিক্ষার্থীরাই সাধারণ শিক্ষার্থী। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা যথারীতি চলছে। এতে কোনো শিক্ষার্থী কোনো প্রকার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে- এ ধরণের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। ক্যাম্পাস এবং হলগুলোতে একই ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে।”

ঢাবি ছাত্রদল ও প্রগতিশীল বাম জোটের নেতাদের কাছ থেকে সহাবস্থান না থাকার অভিযোগের ব্যাপারে উপাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “তুমি দেখি ছাত্রদের মতো করেই বক্তৃতা দিচ্ছো। যেমন করে তারা অপরাজেয় বাংলার সামনে বক্তব্য দেয়। কথাটা বুঝতে পারছো তো, তুমি যে যে কথা বলছো, সেটা তোমার কথা থাকলো। কিন্তু, তুমি আমার প্রভোস্ট কমিটির সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য শুনেছো? প্রভোস্ট কমিটির সকল সদস্য এই কথাটি আমাকে বলেছেন যে, আমাদের হলগুলোতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে। কোনো অভিযোগ তাদের কাছে নেই। তারপরেও যদি কোনো আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক শিক্ষার্থী কোনো সাময়িক অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে, তারা যেনো হল প্রভোস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাহলে উনারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”

ডাকসু নির্বাচনের জন্য ভোট কেন্দ্রগুলো হল থেকে সরিয়ে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তর করতে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনের দাবি প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, “আমাদের গঠনতন্ত্রে সব বলা আছে এবং বলা থাকবে। গঠনতন্ত্রে যা বলা থাকবে ঠিক সে মোতাবেক আমাদের সকল কর্ম-পদক্ষেপ গৃহীত হবে।”

হাইকোর্টের নির্দেশিত সময়ের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবি উপাচার্য বলেন, “সেটা তো জানি না, হাইকোর্টের কোন নির্দেশ? এরকম কোনো আদেশ তো পাইনি। বিষয়টি এখন তোমার কাছে শুনলাম। আমরা তো আমাদের একটা টার্গেট রেখে এগুচ্ছি।”

ডাকসু’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মুশতাক হোসেন বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই হওয়া উচিত। কেনোভাবেই যেনো এই নির্বাচন আবার স্থগিত না হয়ে যায়। দ্বিতীয় কথা হলো যে, ডাকসু যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, সেহেতু সেইরকম ঐতিহ্যের নির্বাচনই আমরা চাই। নির্বাচন না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত থাকতে পারে না। নির্বাচন নিশ্চিত হওয়ার পরেই সেই নির্বাচনের পরিবেশ বা অন্যান্য বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে। গত ২৮ বছর ধরে যেহেতু নির্বাচন হয়নি, এখন আবার কোনো দল যদি বলে নির্বাচন দরকার নেই, তাহলে তো সেই পুরনো জায়গাতেই চলে গেলাম আমরা। কখনও সরকার, কখনও যারা হেরে যাবে ভাবে তারা, কখনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচন বন্ধ করতে চায়। কাজেই শেষ বলিটা হয় ডাকসু নির্বাচন। এবার যেনো ডাকসু নির্বাচনটি বলি না হয়।”

ডাকসু নির্বাচনের জন্য ভোটকেন্দ্রগুলো হল থেকে সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনগুলোতে স্থানান্তরের দাবির প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেন বলেন, “ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু, এটি না হলে যে ডাকসু নির্বাচন হবে না, আমি সেই জায়গাটিতে শংকা প্রকাশ করছি। ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে তো আরও অনেক সমস্যা আছে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনটি নিশ্চিত হওয়ার পর সবার মতামতের ভিত্তিতে সেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। নির্বাচনটি যেন এগুলোর সঙ্গে শর্তযুক্ত না হয়। নির্বাচনের পরিবেশই সহাবস্থানের পরিবেশের নিশ্চয়ই উন্নতি ঘটাবে বলে আমি মনে করি।”

ডাকসু নির্বাচন হওয়া দরকার, তা নিয়ে কারো আপত্তি নেই। প্রশ্ন আসছে স্বাভাবিক পরিবেশ নিয়ে। ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল বড় ছাত্র সংগঠন। ছাত্রদল ক্যাম্পাস বা হলে যেতে পারে না। তার মানে সহাবস্থান নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব ছাত্র সংগঠনও তা বলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা- ‘সহাবস্থান বিরাজ করছে’। এমন ‘সহাবস্থানে’ ডাকসু নির্বাচন তার ঐতিহ্য অনুযায়ী করা যাবে কী না, ভেবে দেখা দরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago