‘ভয়ের সংস্কৃতি’ এবং ‘আমার কী লাভ’

Sultana Kamal
বাপা সভাপতি সুলতানা কামাল। ছবি: স্টার

সুবর্ণচরের চার সন্তানের জননীর ধর্ষণের ঘটনা বড় করে আলোচনায় এসেছে। মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে স্ববিরোধী প্রসঙ্গ আসার পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, ‘এটা মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট নয়’। এছাড়া শিশু থেকে বৃদ্ধ, একের পর এক নিপীড়নের শিকার হয়েই যাচ্ছেন। একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সুলতানা কামাল বলেন, “আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা দাঁড়িয়ে গেছে যে, যারা ক্ষমতার সঙ্গে যেকোনোভাবে সংযুক্ত তারা যেকোনো ধরণের অপরাধ করেই পার পেয়ে যাওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি করে নিয়েছে। তো সেখানে আমাদের প্রশাসন কিংবা পুলিশ বাহিনী যারাই এটার প্রতিকার দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন, তাদের মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যায় যে, ক্ষমতার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে তারা কোনো পদক্ষেপ নিলে তাদের নিজেদের আবার কোনো বিপদ হবে কী না। যেমন, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হয়ে গেছে একটা ভয়ের সংস্কৃতি। প্রত্যেকেই যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে চিন্তা করেন যে, এই পদক্ষেপ নিলে আমার ক্ষতি হবে, না লাভ হবে। যেখানে লাভ হয়, সেই জায়গায় আমরা খুব ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে দেখি। দুই ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ অনেক কিছু করে ফেলে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মানুষকে বেঁধে নিয়ে চলে যায়। হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে চলে যায়।

আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জঘন্য অপরাধ করার পরেও চোখের সামনে তারা ঘুরে-ফিরে বেরালেও তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনোরকম পদক্ষেপ নেয় না। তার কারণ- পুলিশ সারাক্ষণ চিন্তা করছে, ওই পদক্ষেপটা নিলে তার কী হবে।

যারাই রাষ্ট্রীয় জনসেবার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাদের কিন্তু একটা নিয়ম-নীতি থাকে যে, তারা ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগের ঊর্ধ্বে ওঠে কাজ করবেন। সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, প্রত্যেকে কিন্তু সেই নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য। কিন্তু, এখানটায় মোটামুটিভাবে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে, যারা দায়িত্বশীল পদে আছেন, নিশ্চয়ই সেখানে সম্মানিত ব্যতিক্রমরা রয়েছেন, তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রত্যেকেই এই হিসাবটি করে পদক্ষেপগুলো নেন। সেই পদক্ষেপগুলো নিলে তাদের ক্ষতি হবে না লাভ হবে কিংবা তারা বিপদে পড়বেন, না পড়বেন না। এই যে একটা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যেটির সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও চলে আসে।

এসব কারণেই আমাদের এতো নানা ধরনের উন্নয়ন সত্ত্বেও মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনোরকম একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পৌঁছুতে পারছি না।”

কিন্তু, গ্রহণযোগ্য একটি জায়গায় পৌঁছতে তো হবে। তার উপায়টা কী?- প্রশ্নের উত্তরে সুলতানা কামাল বললেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। যেটা দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছিলাম। যা খুবই আশ্চর্যজনক এবং অত্যন্ত দুঃখজনক।

মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের মূল দায়িত্বটাই হচ্ছে জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং সেই মানবাধিকার যদি কোনোভাবে লঙ্ঘিত হয় তার একটি প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার যেকোনো ব্যক্তি যাতে বিচার পায়, সেই পথটি সুগম করে দেওয়ার দায়িত্ব মানবাধিকার কমিশনের। সেই জন্যই আমরা মানবাধিকার কমিশন চাই। মানবাধিকার কমিশনের মূল এবং অন্যতম কাজই হচ্ছে সেটি। সেই জায়গায় আমাদের মানবাধিকার কমিশন যদি তদন্ত করে এসে, যেখানে তাদের তদন্তের মধ্য দিয়েই একটা পর্যায়ে প্রকাশও পাচ্ছে যে, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে কারণ- তিনি একটি বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে গিয়েছিলেন, যারা ধর্ষণ করেছে তাদের তা পছন্দসই হয়নি। আবার অন্য জায়গায় তারা (মানবাধিকার কমিশন) বলছেন যে, এটার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তারা তো স্ববিরোধী কথা-বার্তা বলছেন।

মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি অত্যন্ত সম্মানিত এবং মানুষের প্রত্যাশার একটি বড় জায়গায় এর অবস্থান। সেখান থেকে যদি এ ধরণের কথা-বার্তা আসে, সেটি তো খুবই দুঃখজনক।

মানবাধিকার পরিস্থিতির গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পৌঁছুতে আমাদের আসলে কী করণীয়?- এ প্রশ্নের উত্তরে সুলতানা কামাল বললেন, “যারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল পদে আছেন, তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকে যদি যার যার কাজে সৎভাবে, স্বচ্ছতার সাথে, নির্মোহভাবে, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিবেচনা না করে, যেই বিবেচনায় তারা সেই অবস্থানে গেছেন, সেটি যদি সৎভাবে পালন করেন তখনই এটা সম্ভব এবং সেটি করতে হলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে একটি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।”

আরও পড়ুন:

নির্বাচনের সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক নেই, কমিশন এ কথা বলেনি: মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

ধর্ষণের সঙ্গে রাজনীতি, প্রশ্নবিদ্ধ মানবাধিকার কমিশন

সুবর্ণচরের ঘটনার রেশ না কাটতেই নোয়াখালীতে ফের গণধর্ষণের অভিযোগ

Comments

The Daily Star  | English

Avid TikTokers murdered photographer in Hazaribagh for DSLR camera

The alleged killers were TikTok users who frequently created and shared photos and videos on the platform

36m ago