‘অস্বাভাবিক গণতন্ত্রের চর্চা চলছে’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ২৫৭টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২২টি আসন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র ৮টি আসন পেলেও এখনো শপথ নেয়নি। আওয়ামী লীগ জোট শরীকদের সরকারে রাখা হয়নি। বলা হচ্ছে তারা বিরোধীদলে থাকবে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারে না বিরোধী দলে থাকবে, বেশ কয়েকদিন সিদ্ধান্তহীন থাকার পর জানা গেল তারা বিরোধীদল। রাজনীতির আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, জাতীয় সংসদে বিরোধীদল কে হবে, সেটিও ঠিক করে দিচ্ছে সরকারি দল।
এ বিষয়টি নিয়ে আজ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিকসম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খানের কথা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “বহু আগে থেকেই গৃহপালিত দল বলে একটা কথা প্রচলিত ছিলো। এখন তারই প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে দিনেরবেলায় ভোট হওয়ার কথা কিন্তু রাতের বেলায় ভোট হয়ে যায়। বিরোধীদলও প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বিরোধীদলের আসনে বসে। এগুলো হলো এক শতাংশ লুটেরা ধনীদের নানারকম তামাশা এবং কারসাজি। কিন্তু, দেশ আসলে দুভাগে বিভক্ত। একভাগ লুটেরা শ্রেণি আর নিরানব্বই ভাগ লুটেরাদের দ্বারা শোষিত-বঞ্চিত। আসল বিরোধীশক্তি হলো এই নিরানব্বই ভাগ মানুষ এবং তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে দেশের বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানত প্রকৃত বামপন্থি শক্তিগুলো।”
দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক চর্চা চলেছে সেটি আসলে গণতন্ত্র নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকার তো বলেই দিয়েছে যে, গণতন্ত্র পরে তার আগে উন্নয়ন। এই উন্নয়ন বলতে এক শতাংশ লুটেরাদের ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করা। তারা সরকারের গদিও দখল করেছে, এখন বিরোধীদলকেও দখল করে নিচ্ছে।”
দেশের জনগণ ফের সংগ্রাম করে তাদের অধিকার আদায় করবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ব্রিটিশ শাসকেরা, এমনকি আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, এরশাদও এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলো। ইতিহাসে সাময়িকভাবে তারা সফল হলেও জনগণের শক্তি শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে এবং আগামীতেও সেটিই হবে। সেই লড়াই আগেও ছিলো এবং এই ভুয়া নির্বাচনের পরেও তা অব্যাহত রয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “এটি গণতান্ত্রিক নয় বরং এক ধরনের অস্বাভাবিক চর্চা। তারা জোটবদ্ধভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে। তার ওপর আবার একসঙ্গে দুই মেয়াদে সংসদেও থাকছে। বর্তমানে আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে অস্বাভাবিক গণতন্ত্রের চর্চা চলছে, যা আর কোথাও নেই।”
তিনি বলেন, “যেহেতু এই ধরনের চর্চা বিশ্বের আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। সেহেতু এর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তা বলা কঠিন এবং অসম্ভব। সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে চলার কথা, সেভাবে তো আর চলছে না। সুতরাং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “১৯৯১ সালের পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলো যে ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করেছিলো, এই অবস্থা তৈরির মধ্য দিয়ে তারই একটি পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। ব্যক্তি এবং পরিবারকেন্দ্রীক রাজনীতির মাধ্যমেই দলগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। যদিও, দল পরিচালনার জন্য তাদের গঠনতন্ত্র থাকলেও কোনো দলই এর চর্চা করে না। তাছাড়া, এবার যে ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলো, সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানে, আগে থেকেই নির্ধারিত একটা বিজয় কাঠামো। ফলে নির্বাচন পরবর্তীকালে যখন তারা আবার নতুন করে ক্ষমতাগ্রহণ করলো, তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা আগে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতো, তারাই এখন বিরোধী দলে থাকবে। এটি শুধু নামের পরিবর্তন। বিরোধীদলের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে এই কাঠামোর মধ্যে গণতন্ত্রের লেশমাত্রও নেই।”
এই ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চাকে রাজনৈতিক দল ও গোটা দেশের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে, কাঠামোগতভাবে স্বৈরাচারী চর্চা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তখন ব্যক্তিনির্ভর হয়ে যায়। বাংলাদেশের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বিবেচনা করলে যোগ্য নেতৃত্বের অনুপস্থিতি খুব করে চোখে পড়ে।”
তানজিম উদ্দিন খান আরও বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধনী ও দারিদ্রের বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি আর্থিক কর্মকাণ্ডের পরিসরও বেড়েছে। কিন্তু, গণতন্ত্রহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের বৈধতার সঙ্কটকে ঘিরেই কিন্তু বিদেশি শক্তিগুলো আরও বেশি প্রভাব ও দাপট তৈরি করে। ফলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের সক্রিয়তা বজায় রেখে স্বাধীন বাংলাদেশের যে ধরণের অংশগ্রহণ থাকা উচিত তা ব্যাহত হয়।”
Comments