ডাকসু নির্বাচন: ভোটকেন্দ্র হল থেকে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরের দাবি কেনো?

dacsu photo

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আগামী ১১ মার্চ (রবিবার) অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে ডাকসু’র গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ১৪টি ছাত্রসংগঠনের একাধিক মতবিনিময় সভা হয়েছে। সেখানে ১১টি সংগঠন দাবি করেছে, হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য থাকায় নির্বাচন-প্রক্রিয়া যাতে প্রভাবিত না হয় সেজন্য ভোটকেন্দ্র কাছের একাডেমিক ভবনে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। কিন্তু, এই প্রস্তাবে এখন পর্যন্ত বিপরীত অবস্থানে রয়েছে ছাত্রলীগ।

তাছাড়া, গত ২০ জানুয়ারি ডাকসু নির্বাচনে হলের ভেতরেই ভোটকেন্দ্র করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জন সংক্রান্ত ৫ সদস্যের কমিটি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলছেন, “গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জনে নিয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা সিন্ডিকেট সভায় উঠবে। সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ৮ (ই) ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হলে একটি করে ভোটকেন্দ্র থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট হলের সদস্যরা শুধু ওই হলের ভোটকেন্দ্রেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।

এই বিষয়টি নিয়ে আজ (২৬ জানুয়ারি) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী বাসদ সমর্থিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, “এটি খুব সুস্পষ্ট যে, হলগুলোতে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের কাজ ও স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারে না। হলগুলোতে আসলে প্রশাসনের কোনো কর্তৃত্ব নেই। সেখানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রচণ্ডরকম দখলদারিত্ব বজায় রয়েছে। গণরুম, গেস্টরুমের মাধ্যমে দখলদারিত্ব ও ভয়-ভীতির পরিবেশ পুরো মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। ভোটকেন্দ্র যদি হলগুলোতে হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা বাধাহীন এবং ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে ও গণতান্ত্রিকভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত পারবে না। যার ফলে আমরা বলছি যে, হলগুলোতে নয়, ভোটকেন্দ্র একাডেমিক ভবনগুলোতে হওয়া উচিত।”

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের জন্য ভোটকেন্দ্রগুলো যদি হলেই থাকে তাহলে আমরা আশঙ্কা করছি যে, আরেকটি ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে তো আমরা দেখেছি, সরকার কী করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেহেতু ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেহেতু ছাত্রলীগ তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং দখলদারিত্বের কারণে হলের ভোটকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইবে। সেক্ষেত্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোটারদের জোরপূর্বক নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটবে। সেই আশঙ্কা থেকেই আমরা মনে করছি যে, হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র থাকলে ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।”

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, “আমরা যেহেতু সহাবস্থানের কথা বলছি, সেহেতু দেখা যাচ্ছে হলগুলোতে সহবস্থান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনাবাসিক। যেকোনো ভয়-ভীতির কারণে তারা হলে গিয়ে ভোট দিতে নাও যেতে পারেন। কারণ, হলগুলোর পরিবেশের সঙ্গে তারা পরিচিত নন। কেননা হলগুলোতে প্রতিনিয়ত ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার পাশাপাশি পিটিয়ে বের করে দেওয়ার কারণে এক ধরণের আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজমান। সেই ক্ষেত্রে এই নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু করার জন্য আমরা হলের বাইরে একাডেমিক ভবনগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থানান্তরিত হোক সেটি চেয়েছি।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, “যেকোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলে যারা থাকে, তারাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। হলগুলোতে যদি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন অবশ্যই প্রভাব খাটাবে এবং সেখানে ভোট কারচুপির একটি আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ডাকসু নির্বাচনের জন্য ভোটকেন্দ্রগুলো একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরের জন্য অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবির সঙ্গে আমরা পুরোপুরি একমত। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই নির্বাচনী পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কেবল ছাত্রলীগের জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ছাত্র সংগঠনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাদের।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, “বিগত ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতায়। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিন্দুমাত্র সহাবস্থান নেই। এরকমটি ইতিহাসের কোনোকালেই ছিলো না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। ছাত্রলীগের নেতারা সেখানে মাদকের ব্যবসা পর্যন্ত খুলে বসেছে। তাছাড়া, ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সারাক্ষণই ছাত্রলীগের আতঙ্কে থাকে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ হলের বাইরে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা হলে গিয়ে ভোট দিতে ভয় পাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই ভোটকেন্দ্রগুলো একাডেমিক ভবনে হওয়া উচিত। ছাত্রলীগ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সবগুলো ছাত্র সংগঠনের এই একটাই দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সত্যিকারের ডাকসু নির্বাচন চায়, তাহলে এই বিষয়টিতে তারা নজর দিবে বলে আশা করি।”

ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য প্রায় সব সংগঠনই হলের ভোটকেন্দ্র একাডেমিক ভবনে সরিয়ে আনার কথা বলছে। আপনারা বলছেন, হলের প্রায় সবাই ছাত্রলীগ কর্মী বা সমর্থক। সেক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্র সরিয়ে আনলে আপনাদের তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাহলে কেনো বিরোধীতা করছেন?

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, “আমরা যতো নির্বাচন দেখি, ইউনিয়ন নির্বাচনের ভোট কখনও পৌরসভায় হয় না। আবার পৌরসভার ভোট কখনও ইউনিয়নে হয় না। ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনগুলোতে হবে। হল সংসদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হলে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অন্যথায়, মানুষ ধরে নেবে যে সেখানে সুষ্ঠু ভোট হয়নি বা সুষ্ঠু ভোট হলেও মানুষ সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মন-মানসিকতা সম্পন্ন। এখানে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা আশঙ্কা করার কারণ নেই। ছাত্রলীগ অতীতে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে না। ছাত্রলীগের কাজ তো ভোটকেন্দ্র দখল করা নয়। ছাত্রলীগের কাজ হচ্ছে মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসার মাধ্যমে ভোট আদায় করা। তারা যদি আমাদেরকে ভালোবেসে ভোট দেয়, সেটিকে স্বাগত জানাই। কেউ ভোট না দিলেও তাদের স্বাগত জানাই। সুতরাং, এক্ষেত্রে তো জোর-জবরদস্তি করার প্রশ্নই আসে না।”

আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন ১১ মার্চ

ডাকসু নির্বাচন হবে, কেমন হবে?

Comments

The Daily Star  | English
charges against Sheikh Hasina at ICT

What are the five charges against Hasina at ICT?

Former home minister Kamal and ex-IGP Mamun have also been accused

1h ago