পুলিশ কর্তৃক অপহৃত ৩ যুবক: ৩০ লাখ টাকা দাবি, ২ পুলিশ প্রত্যাহার
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকা থেকে তিন যুবককে অপহরণ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে তাদের প্রত্যাহার করা হয়। অপহৃত যুবকদের উদ্ধার করা হয়েছে।
আমাদের গাজীপুর সংবাদদাতা জানান, অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুন ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মুসফিকুর রহমান।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তিন যুবককে অপহরণ করে তাদের পরিবারের কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। টাকা না দিলে অপহৃতদের ক্রসফায়ারের হুমকিও দেন দুই কর্মকর্তা।
উদ্ধারকৃত যুবকেরা হলেন- গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বড়ইবাড়ি এলাকার হান্নান সরকারের ছেলে রায়হান সরকার, একই এলাকার লতিফ সরকারের ছেলে লাবিব উদ্দিন ও শ্রীপুর উপজেলার চন্নাপাড়া এলাকার মজিবর রহমানের ছেলে নওসাদ ইসলাম মাহফিন। এদের সকলের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর।
যুবকদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে রায়হান সরকার, লাবিব উদ্দিন, নওশাদ ইসলাম ও তাদের অপর দুই বন্ধু তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল রহমান ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার জন্য একটি প্রাইভেটকার নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। পরে তারা গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার জন্য ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর সূত্রাপুর এলাকায় শিলাবৃষ্টি ফিলিং ষ্টেশনে যান। এ সময় তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল রহমান গাড়ি থেকে নেমে পাশের একটি দোকানে চা খেতে যান। গ্যাস নিয়ে তাদের গাড়িটি ফিলিং ষ্টেশন থেকে একটু এগিয়ে গেলে সাদা পোশাকে থাকা কালিয়াকৈর থানার এএসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন একটি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ও মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমানসহ ৩-৪ জন লোক একটি হায়েচ মডেলের মাইক্রোবাস নিয়ে ওই যুবকদের গাড়ির গতিরোধ করেন। পরে গাড়ি থেকে রায়হান মিয়া, লাবিব উদ্দিন ও নওশাদ ইসলামকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যান।
পরিবার সূত্র বলছে, এ সময় চা খেতে যাওয়া অপর দুই বন্ধু রক্ষা পান। পরে অপহরণকারীরা ওই তিন যুবককে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার দেওড়া নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ব্রিজের নীচে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিন বন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের দাবীকৃত টাকা না দিলে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। পরে বেশ কিছু সময় তাদের সঙ্গে টাকা নিয়ে দর-কষাকষি হয়। একপর্যায়ে ওই দুই এএসআই যুবকদের জানান যে ১০ লাখ টাকা দিলেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এরইমধ্যে অপহরণকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল রহমান মুঠোফোনে তাদের পরিবার ও কালিয়াকৈর থানা পুলিশকে অবহিত করেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন মজুমদার বিষয়টি মির্জাপুর থানা পুলিশকে অবহিত করেন। পরে দুই থানার সহযোগিতায় অপহৃত যুবকদের উদ্ধার করে ওইদিন রাত আটটার দিকে প্রথমে মির্জাপুর থানায় এবং পরে রাত ১২ টার দিকে কালিয়াকৈর থানায় নিয়ে আসা হয়।
পরিবার সূত্রে আরও জানা গেছে, ঘটনাটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে জানাজানি হলে বৃহস্পতিবার দুপুরে কালিয়াকৈর থানার এএসআই আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গাজীপুর পুলিশ লাইন্সে ও মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমানকে টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও একাধিক পুলিশ সদস্যের বরাতে আমাদের গাজীপুর সংবাদদাতা জানান, কালিয়াকৈর থানার এএসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমান এক সময় গাজীপুর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) এক সঙ্গে দায়িত্বপালন করেছেন। ওই সময় থেকেই তাদের মধ্যে সখ্যতার সৃষ্টি হয়। ডিবিতে দায়িত্বপালনের সময় তাদের বিরুদ্ধে বহু নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে।
উদ্ধার হওয়া যুবক রায়হান সরকার জানান, তারা পাঁচ বন্ধু বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার সময় ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরো অজ্ঞাত কয়েকজন তাদের ধরে নিয়ে যান। পরে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চান। না দিলে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে তাদের হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।
অভিযুক্ত কালিয়াকৈর থানার এএসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি মুক্তিপণ চাইনি, মুক্তিপণ চেয়েছে মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমান। আমি এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছি। তাদের সহযোগিতা করাটাই আমার ভুল হয়েছে।’
অপর অভিযুক্ত মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘কালিয়াকৈর থানার এএসআই মামুনের পরামর্শেই যুবকদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মামুনই যুবকদের কাছে ৩০ লাখ টাকা চেয়েছে।’
গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ বলেন, “ঘটনাটি জানার পর কালিয়াকৈর থানার ওই এএসআইকে প্রত্যাহার করে গাজীপুর পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।”
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জীত কুমার রায় বলেন, “ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। মির্জাপুর থানার ওই এএসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গাজীপুরের পুলিশ সুপার সামসুন্নাহার বলেন, “এএসআই মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
Comments