ডাকসু নির্বাচন: বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনই অসন্তুষ্ট
পূর্ব নির্ধারিত ১১ মার্চকে নির্বাচনের দিন হিসেবে উল্লেখ করেই গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও, বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় প্রায় সবগুলো ছাত্র সংগঠন ভোটকেন্দ্র হল থেকে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়ে আসছিলো। তবে, এক্ষেত্রে বিপরীত অবস্থানে ছিলো কেবল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ।
দাবি-দাওয়া না মেনে তফসিল ঘোষিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন। দাবি না মানলে আগামী সপ্তাহ থেকে লাগাতার আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিয়েছে তারা।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী বাসদ সমর্থিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, “সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচনের জন্য আমাদের দাবিগুলো ছিলো- হলগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানো, ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান, ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তর এবং ভয়-ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে তারপর তফসিল ঘোষণা করা। কিন্তু, এসব দাবির কোনোটিই মেনে না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করে দিলো। এভাবে ডাকসু নির্বাচনের কোনো মানেই হয় না।”
দাবি আদায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর দুই জোট ‘প্রগতিশীল ছাত্র জোট’ এবং ‘সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ মিলে আগামীকাল প্রতিবাদী মানববন্ধন এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার আন্দোলনে যাবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের কোনো দাবিই মানেনি। ফলে আমাদের মনে হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য তাদের মধ্যে কোনো আন্তরিকতাই নেই। ভোটকেন্দ্র হলে থাকলে কেন্দ্র দখল হবে এবং দখলদারিত্বের নির্বাচন হবে। তাই আমরা ভাবছি আন্দোলনে যাবো।”
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আরও ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ও আচরণ বিধিমালা সংশোধন পর্যায়ে আমরা ‘ক্লাস ক্যাম্পেইনিং’ ও ভোটকেন্দ্রগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার দাবি করেছিলাম। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় সবগুলো ছাত্র সংগঠনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে একপাক্ষিক মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছে- যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবে এখনও সময় আছে, আমরা আশা করি প্রশাসন চাইলে এসব দাবি মেনে নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা করবে।”
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, “ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নেওয়া, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ ও প্রার্থিতার জন্য বয়স-সীমা বেঁধে না দেওয়াসহ বেশ কিছু দাবি পেশ করেছিলাম। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব দাবি আমলে না নিয়েই তফসিল ঘোষণা করেছে। এতে করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এখানেও একটি প্রহসনের নির্বাচনের আশঙ্কা করছি। তারপরও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আমরা একটি পুনঃতফসিলের দাবি জানাচ্ছি।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে আমরা নেতিবাচকভাবে নিচ্ছি না। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো দাবিই পূরণ না করে কেবল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মতামতই গ্রহণ করেছে। তাছাড়া, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি আমার ওপর হওয়া হামলাই প্রমাণ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো সহাবস্থান নেই। যাই হোক, সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই দাবিগুলো পুনর্বিবেচনা করবে বলেই আশা করি।”
ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্বাচিত নেতৃত্বের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা এমন ধরনের ছাত্র রাজনীতি চায়, যারা তাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। তাদের সমস্যা-সঙ্কট দূরীভূত করে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ করবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ইচ্ছা ও স্বপ্নের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি তফসিলে প্রতিফলিত হয়েছে কী না?- জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, “যেসব আলোচনার ভিত্তিতে আচরণবিধি তৈরি হয়েছে, সেগুলো একটু দেখে নিন। দেখলে নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে কী হচ্ছে। যেসব বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি ছিলো, সংশ্লিষ্ট কমিটি তাদের কাছ থেকে লিখিত মতামত নিয়ে যে সুপারিশ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সেগুলোই গ্রহণ করেছে।”
এরপর আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী মুঠোফোন সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনের দাবি না মেনেই ঘোষিত তফসিলের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলো।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও কথা বলা হবে জানালে উপাচার্য বলেন, “সাংবাদিকতার এথিকস তোমার একটু দুর্বল। প্রতিক্রিয়া মানে কি? এথিকস ঠিক রেখে কাজ করো।”
তারপর তিনি বলেন, “তোমার নাম কি?”
পুনরায় নাম ও পরিচয় বলার পর তিনি বলেন, “ভালো তো, ভালো ভালো কাজ করো। তফসিল হয়ে গেছে। পেয়েছো তফসিল?”
তফসিল পাওয়ার বিষয়টি জানানোর পর তিনি বলেন, “তফসিলটি পত্রিকায় সুন্দর করে ছাপিয়ে দাও।”
এই কথা বলে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিনিও মুঠোফোন সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান বলেন, “প্রথমত এগুলি নিয়ে আমরা সাক্ষাৎকারে কিছু বলবো না। যেহেতু আমরা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এই দাবি-দাওয়াগুলো আপনাদের সবার জানা আছে। কে, কোথায় কী বলেছে তা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। আর চূড়ান্তভাবে আমাদের যে গঠনতন্ত্র সংশোধিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ফলে, নিজে নিজেই আন্দাজ করে নিতে হবে যে, কোনটি প্রতিফলিত হয়েছে আর কোনটি হয়নি।”
তফসিল ঘোষণার পরেও বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন তাদের দাবিতে অনড় রয়েছে জানালে তিনি বলেন, “আর তো কিছু করার নেই। এটি সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি কাঠামোর মাধ্যমে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডি আছে, বিশেষভাবে সিন্ডিকেট। তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সে প্রক্রিয়ায় তো সবকিছু বিবেচনা করেই করে। কোনটা করা সম্ভব, কোনটা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ঠিক থাকবে। তাছাড়া, এগুলো প্রশাসনিক বিষয়, এসবের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত সাত-সদস্যের আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ বলেন, “বলা হয়েছে যে সক্রিয় ছাত্র-সংগঠনগুলোর দাবি-দাওয়া পূরণ হয়েছে কী না। আমাদের পক্ষ থেকে তো অবশ্যই বলবো যে হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা নানা দাবি-দাওয়া করেছে, যেগুলো নিয়ে কথা-বার্তাও চলছে। আমি অন্তত এখানে বলবো, আমি তো এর সঙ্গে সেরকমভাবে জড়িত না। আমার কাছে এ ধরনের দাবি আসছে না। হয়তো উপাচার্যের কাছে আসছে অথবা এখন আমাদের যিনি নির্বাচন কমিশনার রয়েছেন উনার কাছে যাচ্ছে। সুতরাং তারাই এসব ব্যাপারে ভালো উত্তর দিতে পারবেন।”
আরও পড়ুন:
ডাকসু নির্বাচন: ‘পরিবেশ আছে’, ‘পরিবেশ নেই’
ডাকসু নির্বাচন: ভোটকেন্দ্র হল থেকে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরের দাবি কেনো?
Comments