এক ফুটবলপ্রেমী দিনমজুরের গল্প

রায়হান বুলু একজন স্বেচ্ছাসেবী ফুটবল প্রশিক্ষক। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে তিনি নিজ খরচে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ১ম থেকে ১০ম শ্রেণির ছাত্রদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। আর এক কাজ করতে গিয়ে রায়হান হারিয়েছেন তার প্রায় সবকিছুই।
Raihan Bulu
স্বেচ্ছাসেবী ফুটবল প্রশিক্ষক রায়হান বুলু। ছবি: স্টার

রায়হান বুলু একজন স্বেচ্ছাসেবী ফুটবল প্রশিক্ষক। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে তিনি নিজ খরচে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ১ম থেকে ১০ম শ্রেণির ছাত্রদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। এই কাজ করতে গিয়ে রায়হান হারিয়েছেন তার প্রায় সবকিছুই।

গাবতলী উপজেলার কদমতলী গ্রামের একটি ছোট্ট টিনের ঘরে বাস করেন ৪৮ বছর বয়সের রায়হান। কিন্তু, ৬ মাস আগেও থাকার জন্য ৩১ টিনের একটি বড় ঘর ছিলো তার। গত রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের সময় তার ছাত্ররা দাবি করে যে তাদের ফুটবল ও জার্সি প্রয়োজন। রায়হান একজন দিনমজুর। বাচ্চাদের দাবি মিটানোর সমর্থ তার ছিলো না। উপায় না দেখে তিনি বড় ঘরটি ভেঙ্গে টিন বিক্রি করলেন ১৭টি। টাকা পেলেন সাড়ে ১৩ হাজার।

বিশ্বকাপের সময় ফুটবল এবং দুই সেট জার্সি কিনলেন সাড়ে ৬ হাজার টাকায়। এখন রায়হানের ছোট ঘরের চালে রয়েছে মাত্র সাতটি টিন আর ঘরের চার দেওয়ালে রয়েছে বাকি সাতটি। অবুঝ শিশুদের আবদার রাখতে গিয়েই তার এতো বড় আত্মত্যাগ।

এ যাবৎ দিনমজুরি করে তিনি যা আয় করেছেন তার সবটাই খরচ করেছেন বাচ্চাদের ফুটবলের পিছনে। ফুটবল, জার্সি, নাস্তা, অ্যাংলেট, ব্যথানাশক ঔষধ ও বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যাওয়ার খরচ তিনি নিজেই বহন করেন।

Raihan Bulu
মাঠে শিশুদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন রায়হান বুলু। ছবি: স্টার

এ পর্যন্ত তিনি শিশুদের পিছনে ৩ লাখের বেশি টাকা খরচ করেছেন। একমাত্র শারীরিক শ্রম তার আয়ের প্রধান উৎস। তাছাড়াও তার রয়েছে ২৫ শতকের একটি পুকুর। সেই পুকুর ইজারা দিয়ে তিনি বছরে যে ৮ বা ৯ হাজার টাকা পান তাও খরচ করেন বাচ্চাদের পিছনে। রায়হান একসময় কদমতলী বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। বিদ্যালয় ছুটির সময়ে তিনি চর এলাকায় খেত-খামারে দিনমজুরের কাজ করে কিছু রোজগার করতেন এবং তার অনেকটাই খরচ করতেন শিশুদের পিছনে।

তবে, রায়হান ফুটবল কোচ হিসেবে একেবারে ব্যর্থ হননি। গত বছরের ডিসেম্বরে তার ছাত্ররা (কদমতলী প্রাথমিক বিদ্যালয় টিম) বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে সেরা হয়ে রাজশাহী বিভাগ পর্যায়ে খেলে এসেছে।

কদমতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “খেলাধুলা হলো বাচ্চাদের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার একটি উন্নত সামাজিকীকরণ-মাধ্যম। আর আমাদের রায়হান বুলু সেই কাজটিই করছেন নীরবে। তিনি আমাদের বাচ্চাদের একজন স্বেচ্ছাসেবক কোচ। তাকে আমরা এই কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দিতে পারি না, তিনি নিজের টাকা খরচ করে এই কাজ করেন। গত বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে তিনি বাচ্চাদের বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের গর্বিত করেছেন।”

রায়হান বুলু বলেন, “এ যাবৎ আমি প্রায় ২,০০০ ছেলেকে শারীরিক শিক্ষা ও ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের মধ্যে ১০-১২ জন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ ও আনসারে খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়েছেন।”

রায়হানের পড়ালেখা অনেক কম। মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অভাবের কারণে আর পড়তে পারেননি তিনি। তার ছাত্র নাহারুল ইসলাম এখন পাবনা পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “আমার ফুটবলের হাতেখড়ি রায়হান স্যার এর কাছে। ছোটবেলা থেকে আমি তার কাছে ফুটবলে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এলাকার প্রত্যেকটি গ্রাম থেকে তিনি প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের এনে বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দেন। শুধু তাই নয় তাদের শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়ান। এই করে তিনি তার সব শেষ করেছেন। এখন তার সম্পদ বলে আর কিছুই নেই।”

১৯৮০ দশকে বুলু আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। সেই প্রশিক্ষণের কিছু শিক্ষা তিনি তার ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন। বিশেষ করে শারীরিক ও পরিবেশ-প্রতিবেশ-এর শিক্ষা।

Raihan Bulu
শিশুদের নিয়ে প্রশিক্ষণমাঠে রায়হান বুলু। ছবি: স্টার

আশপাশের ১১ গ্রামের শিশুদের তিনি ফুটবল প্রশিক্ষণ দেন। গ্রামগুলো হলো সরাতলী, ধলির চর, জাত হলুদিয়া, বুরুজ, বালুভাঙ্গা, ধনঙ্গা, বিল সরলিয়া, কাজলাপাড়া, দরিপাড়া, কল্যাণপুর এবং কদমতলী। এলাকার চারটি বিদ্যালয়ের মাঠে তিনি শিশুদের প্রশিক্ষণ দেন।

নেপালতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লতিফুল বারী মিন্টু বলেন, “রায়হান বুলু অনেক বছর হলো এলাকার ছোট বাচ্চাদের বিনা পয়সায় ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। এ কাজে যে খরচ হয় তার সবটাই তিনি নিজে বহন করেন। আমরাও মাঝে-মাঝে তাকে সাহায্য করি। এলাকার শিশুদের ফুটবল খেলার উন্নয়নে তার অবদান অনেক বেশি।”

কদমতলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক মমিরুল ইসলাম বলেন, “রায়হান বুলু একজন সংস্কৃতিমনা লোক। যেখানেই খেলাধুলা বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক না কেনো বুলু সবার আগে সেখানে হাজির হন। তার এই অবদানের কথা চিন্তা করে আমরা তাকে এই বিদ্যালয়ের গেটকিপার হিসেবে গত জানুয়ারি মাসে নিয়োগ দিয়েছি।”

২০০২ সালে রায়হান তার স্ত্রী এবং তিন ছেলে-মেয়েদের নামে বসত বাড়ির ১৩ শতক জমি লিখে দেন। কিন্তু, তিনি অসুস্থ হলে তার স্ত্রী-সন্তানরা তাকে ত্যাগ করে। কারণ, তিনি তার সমস্ত উপার্জন শিশুদের খেলার পিছনে খরচ করেছেন। এ কারণে তারা তার চিকিত্সার ব্যয়ভার নিতে চাননি। তারপর থেকে রায়হান পুকুরের উপর একটি টিনের ঘর তৈরি করে সেখানেই পরিবারহীন জীবন-যাপন করতে শুরু করেন। এখন তিনি ছাত্রদেরকেই তার সন্তানের বলে মনে করেন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago