‘নারী-পুরুষ এখন এক কাতারে’

আমরা নারীরা প্রতিটা জায়গায় আছি, উন্নতি করছি। কোনখানে আমরা নারীরা নেই? সবখানেই এখন নারীদের জাগরণ। কী করছে না এখন নারীরা? তারা বিমান চালাচ্ছে, দেশ পরিচালনা করছে, কতোকিছু করছে নারীরা। পুরুষের তুলনায় আমরা একটুও পিছিয়ে নেই।
Bobita
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা। ছবি: স্টার

আমরা নারীরা প্রতিটা জায়গায় আছি, উন্নতি করছি। কোনখানে আমরা নারীরা নেই? সবখানেই এখন নারীদের জাগরণ। কী করছে না এখন নারীরা? তারা বিমান চালাচ্ছে, দেশ পরিচালনা করছে, কতোকিছু করছে নারীরা। পুরুষের তুলনায় আমরা একটুও পিছিয়ে নেই।

আমরা যখন প্রথম চলচ্চিত্রে এসেছিলাম, তখন আমাদের নিয়ে অনেক কথা বলা হতো। মনে হতো কী যেন খারাপ একটা কিছু করছি। আমাদের পরিচিত মানুষেরা বলত অধঃপতন হয়েছে আমাদের। পরিচিত অনেক মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাদের মনে হয়েছিলো আমরা খারাপ কিছু করছি। এসব কথা শুনে মনটা অনেক খারাপ হতো।

কিন্তু, একটা সময় যখন দেখলো দেশে-বিদেশে আমার অভিনীত ছবি ‘অশনি সংকেত’ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। দেশে-বিদেশের গণমাধ্যমগুলো যখন আমাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করলো তখন তারা বললো, ববিতা ও সুচন্দা আমাদের গর্ব। আস্তে আস্তে বিষয়গুলো তারা বুঝতে শুরু করলো।

নারী হিসেবে কখনো আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। প্রথমদিকে অনেকেই বলত নারী হিসেবে সিনেমা করছি, গান-বাজনা ও নাচ করছি। এটা ঠিক হচ্ছে না। ধীরে ধীরে মানুষের মন পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ এখন বুঝতে পারছে এটা একটা পেশা। যতো দিন যাবে মানুষ এটা অনুধাবন করতে শিখবে। তাদের ভুলগুলো ভাঙবে। এখন কতো কতো সুন্দরী প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নারীরা তাদের সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাদের মেধা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, মানুষ এসব নিয়ে আগে অনেক খারাপ কথা বলতো। সে সময় এখন আর নেই। নারী-পুরুষ এখন এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তাই বলছি আমি নারী হিসেবে কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি।

শুধু কী সুন্দরী প্রতিযোগিতা? এর পাশাপাশি খেলাধুলা, লেখাপড়া থেকে শুরু করে নারী এখন পর্বতের উচ্চশিখরে পর্যন্ত যাচ্ছে। তাহলে কোথায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে?

আগে বলা হতো- না, নারী মানে সে শুধু ঘর ঠেলবে আর সংসার সামলাবে। আর পুরুষ শুধু উপার্জন করবে। এসব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। এখন নারী-পুরুষ সমানে সমান। এখন তারা সবাই মিলেমিশে কাজ করছে, সংসার করছে। মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা অনেক ভালো একটা দিক। নারীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনেক গুণ। সেই বিশ্বাসের জোরে ধাপে ধাপে নারীরা এখন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। একজন নারী হিসেবে আমার অনেক গর্ব হয় এসব দেখে। নারীরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে।

এখন নতুন যে নারীরা সিনেমায় আসছে, তারা অনেক প্রতিভাবান। তারা অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। কিন্তু প্রতিভাবান এসব মেয়ে ভালো পরিচালক পাচ্ছে না, যেখানে তাদের প্রতিভাটা তুলে ধরবে। এখানেই আমার দুঃখ হয়। আমি বেণী দোলানো বয়স থেকে সিনেমার সঙ্গে আছি। অনেক প্রতিভাবান পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। তখন আমার বয়স ছিলো ১১ বছর। কতো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজকে হয়তো একটা অবস্থানে এসেছি। একা-একা দেশ-বিদেশের শুটিংয়ে গেছি। আমার বাবা-মা বলে দিলেন, “তোমার ভালো-মন্দ তোমাকেই দেখতে হবে।” তখন থেকেই নিজের ভালো-মন্দ নিজে দেখে আসছি। কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। এগুলো শিখতে হবে সিনেমায় আসা নতুন নারীদের। তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না বলে আমার বিশ্বাস। নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আসলে কেউ তো পাহারা দিয়ে রাখবে না। এর ফলে ভালো-মন্দ কী- তা শিখেছি। কীভাবে সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে- সেটা বুঝেছি।

নতুন নারী যারা সিনেমায় আসছে তারা সত্যি অনেক প্রতিভাবান। তাদের এই প্রতিভা কাজে লাগাতে হবে। তাহলে তাদের কেউ আটকে রাখতে পারবে না। একজন জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন, কাজী জহিরের মতো পরিচালক পেলে নতুন নারীরা অনেক ভালো-ভালো সিনেমা আমাদের উপহার দেবে বলে আমার বিশ্বাস। আগে যেমন সিনেমায় একটা বক্তব্য থাকতো, ম্যাসেজ থাকতো- এখন সেটা খুব বেশি দেখা যায় না। এমন হলে নতুন আসা মেয়েরা অনেক ভালো করবে। শুধু নিজেকে পর্দায় দেখাতে চাইলে হবে না। অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে। ভালো-ভালো পরিচালক পেলে এই নারীরা আমাদের ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি। পাশাপাশি মন-মানসিকতা ভালো থাকতে হবে। সেক্রিফাইজ করতে হবে। শুধু টাকা-টাকা করলে হবে না। অনেক সিনেমায় ভালো গল্প-চরিত্রের জন্য পারিশ্রমিক নেইনি। ভালো সিনেমার জন্য অনেক কিছু ছাড় দিয়েছি। ভালো-ভালো ছবিতে কাজের তৃষ্ণায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছি। শুধু ভালো গল্প আর চরিত্রের জন্য। এসব ছবি করে দেশে-বিদেশে মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, হাততালি, কত অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। আর কী লাগে এক জীবনে। এই মানসিকতা এখনকার নতুন নারীদের মধ্যে থাকতে হবে। শুধু টাকা-টাকা করলে হবে না। টাকা সবকিছু নয়- এটা বুঝতে হবে। কিছুই থাকবে না, শুধু অর্জন থাকবে। ইতিহাসের পাতায় টাকা থাকবে না, অর্জনগুলো থেকে যাবে। এটা বিরাট একটা পাওয়া। এই যে সত্তরটা পুরস্কার পেয়েছি, তার জন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এগুলো নারীদের মনে রাখতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। তাহলে সবকিছু হবে। সবশেষে বলি, নারীরা এগিয়ে যাক আরও সামনে।

অনুলিখন: জাহিদ আকবর

(আগামীকাল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে স্বনামধন্য অভিনেত্রী ববিতার এই লেখা)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago