রাতের ভোট!

দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। তাদের কার্যক্রম অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ কারা পরিচালনা করবেন, তা নির্ধারিত হয়। সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন একটি কথা বলেন স্বাভাবিকভাবেই তা গুরুত্ববহন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিগত নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। কথাগুলো শুধু গুরুত্বপূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণই নয়, ভিন্নমাত্রার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জেনে নেওয়া যাক তিনি কী বলেছেন-
cec
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। ফাইল ছবি

দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। তাদের কার্যক্রম অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ কারা পরিচালনা করবেন, তা নির্ধারিত হয়। সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন একটি কথা বলেন স্বাভাবিকভাবেই তা গুরুত্ববহন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিগত নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। কথাগুলো শুধু গুরুত্বপূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণই নয়, ভিন্নমাত্রার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। জেনে নেওয়া যাক তিনি কী বলেছেন-

“... যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।” (প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৯)।

রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তির জন্যে কারা দায়ী, সেটা বলার সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই বলেও জানান সিইসি।

“কারা সেজন্য দায়ী, তাদেরকে কী করা যাবে… সেই দীক্ষা-শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ কোনো নেই যে, কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী।” (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)।

তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ছবিযুক্ত, ভোটার তালিকা দিয়েও এখন কাজ হচ্ছে না। ‘নির্বাচনের মত ছোট বিষয়ে’ তিনি সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও পক্ষে নন। পৃথিবীর কোন দেশ জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করে?- প্রশ্ন করেছেন সিইসি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়-

ক. নির্বাচন কমিশন অবগত ছিলো যে, নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়েছিলো।

খ. যারা রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরেছিলেন, তাদের কিছু বলার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।

গ. ইভিএম ব্যবহার করলে আর আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখা যাবে না।

২.

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগের ২৯ ডিসেম্বর রাত ১০টার পর থেকে অভিযোগ করা হয়েছিলো ‘ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানো হচ্ছে’। সেই অভিযোগ নির্বাচন কমিশন আমলে নেয়নি। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই স্বীকার করছেন, রাতে ভোটের বিষয়টি। কেনো তিনি তখন কিছু বলেননি বা করেননি? যারা রাতে ভোট দিয়েছেন তাদের বলার ‘দীক্ষা-শিক্ষা, ক্ষমতা-সুযোগ-যোগ্যতা’ নির্বাচন কমিশনের নেই, তিনি নিজেই তা বলছেন। কিন্তু, আমরা তো জানি যে, নির্বাচন কমিশন যাদের প্রয়োজন মনে করেন তাদের নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। যাদের সম্পৃক্ত করেন তাদের শুধু কিছু বলা নয়, তাদের বিষয়ে যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার- ক্ষমতা, সুযোগ নির্বাচন কমিশনের আছে। বাংলাদেশের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। ’দীক্ষা-শিক্ষা’ নির্বাচন কমিশনের, না প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নেই, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

প্রাসঙ্গিকভাবেই মানুষের জানতে ইচ্ছে করবে, নির্বাচন কমিশন যাদের নিযুক্ত করেছেন তাদের বাইরে অন্য কেউ বা কোনো শক্তি রাতের বেলা ব্যালটবাক্স ভরাট করেছেন? নির্বাচন কমিশনকে অবহিত না করে সরকার নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে কাউকে নিযুক্ত করতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন কখনো তেমন কোনো অভিযোগ করেওনি। তাহলে রাতের বেলা ব্যালটবাক্স ভরনেওয়ালাদের কে বা কারা নিযুক্ত করলো? নির্বাচন কে করছে? নির্বাচন কমিশন, না অন্য কেউ?

ইভিএম বিষয়ে অনেকবার বিস্তারিত লিখেছি। এই আলোচনায় বিস্তারিত বলছি না। প্রাসঙ্গিকভাবে যা না বললেই নয়, রাতে ব্যালটবাক্স ভরনেওয়ালাদের নির্বাচন কমিশন যদি কিছু বলতে না পারে, তাহলে ইভিএম মেশিনগুলো তারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? যারা রাতের বেলা বাক্স ভরেছেন, তারা ইভিএম মেশিনেও রাতে ভোট দিলে ঠেকাবেন কীভাবে? ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরতে তাও তো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। ইভিএমে তো খুব অল্প সময়ে অনেক ভোট দেওয়া যায়।

যার ভোট তার স্মার্ট কার্ড বা আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া মেশিনে ভোট দেওয়া যাবে না বলে যা বোঝানো হচ্ছে, যা তথ্য হিসেবে সঠিক নয়। প্রিসাইডিং অফিসার নিজে যে কারো ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সেভাবেই মেশিনের প্রোগ্রাম সেট করা থাকে। সাধারণত প্রিসাইডিং অফিসার ২৫ জনের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এই সংখ্যা বাড়ানো, প্রোগ্রাম যারা সেট করবে তাদের কাজ। সুতরাং ইভিএমেই সমাধান- এই বক্তব্যও মেনে নেওয়া যায় না।

৩.

রাতে ব্যালটবাক্স ভরা বিষয়ে সিইসি এখন যা বলছেন, নির্বাচনের পরপরই তা সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলো টিআইবি। ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে তারা ৪৭টি কেন্দ্রে অনিয়ম পেয়েছিলো। ৩৩টিতে আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখার প্রমাণ পেয়েছিলো। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ ভাগ কেন্দ্রে রাতে ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো।

সেই সময় টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনকে নির্বাচন কমিশন বলেছিলো, এটা কোনো গবেষণাই নয়। পূর্ব নির্ধারিত মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। কিন্তু, সিইসির এখনকার বক্তব্য আর টিআইবির প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সিইসির বক্তব্য নিশ্চয় মনগড়া নয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী এটি কি অনুমিত হয় না যে, টিআইবির প্রতিবেদন সঠিক ছিলো?

ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে ব্যালটবাক্স ভর্তির ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলো বিবিসি। নির্বাচন কমিশন বেলা ৩টার দিকে ওই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বাতিল করে দিয়েছিলো? রাতে কারা ব্যালট বাক্স ভরলো, নির্বাচন কমিশন তা তদন্ত করে প্রকাশ করেনি।

খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোট বেশি হয়ে গিয়েছিলো। রিটার্নিং অফিসারের দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী রিপোর্ট প্রকাশ করায় অসত্য সংবাদ প্রকাশের দায়ে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্তু, সংবাদটি যে অসত্য ছিলো না, ডয়চে ভেলেসহ অন্যান্য গণমাধ্যম তথ্য ও ভিডিওচিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলো। বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো। এসব ঘটনাগুলোর কোনো তদন্ত নির্বাচন কমিশন করেছে- এমন তথ্য জানা যায়নি।

এখন কী বিবিসির ভিডিওচিত্র, ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটের ভিডিওচিত্র, টিআইবির প্রতিবেদন ও সিইসির বক্তব্য আমলে নিয়ে, রাতে ভোটের বিষয়ে একটি সামগ্রিক তদন্তের উদ্যোগ নিবে নির্বাচন কমিশন?

৪.

রাতে ভোট বিষয়ক অভিযোগের এখানেই শেষ নয়।

‘ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে’- জাসদ নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া, (দ্য ডেইলি স্টার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।

‘উপজেলা নির্বাচনে এবার রাতের বেলা ভোট হবে না। এখন দিনের বেলাতেই হবে ভোট ডাকাতি’- রাশেদ খান মেনন, (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মার্চ ২০১৯)।

শরীফ নুরুল আম্বিয়ার জাসদ এবং রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশ। দুজনের বক্তব্য থেকেও রাতে ভোটের বা ব্যালটবাক্স ভরে রাখার তথ্য মিলছে। যে নির্বাচনে রাতে ভোটের কথা বলছেন, সেই নির্বাচনে রাশেদ খান মেনন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জাসদ থেকেও মইনউদ্দিন খান বাদল এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

বামজোটও বলেছে ভোট ডাকাতি হয়েছে, রাতের বেলা ভোট হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি ‘রাতে ব্যালট বাক্স’ ভরে রাখা বক্তব্যের অধিকতর ব্যাখ্যা দিবেন? যারা রাতে বাক্স ভরলেন তাদের নির্বাচন কমিশন যেহেতু কিছু বলতে পারেনি, গণমাধ্যমের সামনে এসে তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার অক্ষমতার কথা বলতে পারেন। কারা রাতে ভোট দিলো, তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানেন। তিনি যদি বলেন ‘কিছু বলার সুযোগ নেই’ বা ‘ক্ষমতা নেই’- এই নির্বাচনটিকে ইতিহাস কীভাবে মূল্যায়ন করবে?

নির্বাচন কমিশন বলছে, উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম হলে সেই আসনের নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া হবে। তিনি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন বাতিল করে দিতে চাইছেন, অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন সম্পর্কে কথা বলবেন না কেনো? আপনাদের যে কাজ করা সাংবিধানিক দায়িত্ব, সেই কাজ বিষয়ে আপনারাও যদি অভিযোগের সুরে কথা বলেন, কাজটি করবেন কে?

‘সুযোগ নেই’, ‘ক্ষমতা নেই’ বললে কী সাংবিধানিক এই পদে থাকার যৌক্তিকতা থাকে?

Comments

The Daily Star  | English
Badiul Alam Majumder

Elections won’t be unacceptable without AL: Badiul Alam

Dr Badiul Alam Majumdar, secretary of 'Citizens for Good Governance' (SHUJAN), has said elections will "not be unacceptable" without Awami League's participation..AL has completely destroyed the electoral system in this country by conducting "dummy, one-sided and midnight" elections, he sa

1h ago