এক টাকার মাস্টার!
৬৯ বছর বয়েসী লুত্ফর রহমান। থাকেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের পাশে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি বাঁধে। বিগত ৪০ বছর ধরে এলাকার লোকজন তাকে ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসাবে চেনেন।
১৯৭৯ সাল থেকে তিনি ওই এলাকার নদী পাড়ের সুবিধাবঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়ান। বিনিময়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে তিনি প্রতিদিন নেন মাত্র এক টাকা। নিজের পরিবারের সুখ-শান্তির চিন্তা না করে আজও তিনি এই শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার আলো।
এক টাকার মাস্টার লুত্ফর রহমানের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ আগস্ট ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া গ্রামের এক ধনাঢ্য পরিবারে। তার বাবার নাম ফইমুদ্দিন ব্যাপারী।
লুত্ফর রহমান ফুলছড়ি উপজেলার গুনভরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙ্গনে তার পিতা সর্বস্বান্ত হলে অর্থাভাবের কারণে তিনি আর পড়াশুনা করতে পারেন নি।
নদী ভাঙ্গনের পরে তিনি গাইবান্ধার সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেন। সেই থেকে এক টাকার বিনিময়ে তার ছাত্র পড়ানো শুরু। গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি তার বাড়িতে গিয়ে দেখেন বাড়ির দরজায় তালা বন্ধ।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিকেল সাড়ে দিনটার দিকে ক্লান্ত লুত্ফর মাস্টারকে বাইসাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সকাল থেকে তিনি এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রামে (মদনের পারা, পুলবন্ধি, চন্দিয়া, ঢুলি পারা এবং নিজ গ্রাম বাগুরিয়া) ছাত্র পরিয়েছেন।
ইতিমধ্যে গ্রামের ১৬ জন খুদে শিক্ষার্থী তার বাড়িয়ে এসে হাজির হয়েছে পড়ার জন্য। বিকেল ৪ টা থেকে ৬ পর্যন্ত লুত্ফর মাস্টার এদের পরবেন।
লুত্ফর মাস্টারের স্ত্রী লতিফুল বেগম বলেন, “এইভাবেই তার স্বামী প্রায় ৪০ বছর ধরে এক টাকার বিনিময়ে পাড়ায় পাড়ায় ছাত্রদের প্রাইভেট পাড়িয়ে যাচ্ছেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে গাছতলা, বাঁশতলা ও বাড়ির উঠান যেখানেই সুযোগ পান সেখানেই বাচ্চাদের পাঠদান করেন তিনি।”
এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গাইবান্ধা জেলা পরিষদ তার স্বামীকে একটি বাইসাইকেল কিনে দিয়েছেন ২০১৮ সালে। তার আগে প্রায় ৩৯ বছর যাবত তার স্বামী মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাচ্চাদের প্রাইভেট পরিয়েছেন, জানান তার স্ত্রী লতিফুল বেগম।
প্রথমে সংসারের অভাবের তাড়নায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক টাকার বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর কাজ শুরু করলেও, পরবর্তীতে তিনি এই পেশার মাঝেই আত্মতৃপ্তি খুঁজে পান এবং অন্য কোনো পেশার কথা কখনো চিন্তা করেননি বলে জানান লুত্ফর রহমান।
এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লুত্ফর মাস্টার একজন সাদা মনের মানুষ এবং অত্র এলাকায় শিশু শিক্ষার উন্নয়নে একজন নিবেদিতপ্রাণ। এলাকার কিছু সংগঠন তাকে সাদা মনের মানুষ হিসেবে পুরস্কৃত করেছে। পুরস্কৃত করেছে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাছে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
এক সময়ের চৌকস লুত্ফর মাস্টার বয়সের ভারে এখন কিছুটা নুয়ে পড়েছেন। এখন আগের মত আর ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না, কিন্তু তাই বলে বন্ধ করেননি তার এই ভ্রাম্যমাণ শিক্ষার স্কুল। এখনও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের।
“ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত গিদারী ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ হলো দরিদ্র কৃষক। মূলত যেসব অভিভাবকরা টাকার অভাবে সন্তানদের ভালো মাস্টার দিতে পারেন না কিংবা ভালো কোচিং বা স্কুলে দিতে পারেন না, তারাই বাবার কাছে সন্তান দেন পড়ানোর জন্য”, বলেন তার বড় ছেলে লাবলু মিয়া (৩৮)।
এক টাকায় কেনো পড়ান? জানতে চাইলে ৬৯ বছর বয়সের এই শিক্ষক বলেন, “এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষই গরিব। তাছাড়া আমি টাকার জন্য পড়াই না। আমি পড়াই যাতে ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে দেশের সম্পদে পরিণত হয়। পিতা-মাতার মুখে হাসি ফুটাতে পারে।”
লুত্ফর রহমান জোর দিয়ে বলেন যে, একজন শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে কখনই দরিদ্র হতে পারে না।
৩৯ বছর ধরে এক টাকায় পড়িয়ে আপনার প্রাপ্তি কী? জানতে চাইলে লুত্ফর রহমান বলেন, “আমি যা পেয়েছি তা খুব কম লোকই পায়। এই এলাকার সবাই আমাকে শিক্ষক হিসাবে সম্মান করে। হিন্দু-মুসলিম সব ধরনের মানুষ আমাকে সম্মান করে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী আছে?”
লুত্ফর রহমান গর্ব করে বলেন, “আমি জীবনে হাজার হাজার ছেলে-মেয়েকে পড়িয়েছি। আমার অনেক ছাত্র এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার ও আইনজীবী হয়েছে|
তার ছাত্র মো. মেহেদী হাসান (নাজির), উপ-সহকারী প্রকৌশলী, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর পীরগাছা উপজেলা (রংপুর) বলেন, “আমি লুত্ফর মাস্টারের একজন ছাত্র ছিলাম। ১৯৯৬ সালের দিকের কথা, আমি টাকার অভাবে ভালো মাস্টারের কাছে পড়তে পারতাম না তখন লুত্ফর স্যার এক টাকা দিন নিয়ে আমাকে পরিয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি পরিবারের কাছে অনেক হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন কিন্তু তার লক্ষ থেকে স্যার আজও সরে আসেননি।”
একই কথা বলেছেন তার বড় ছেলে লাবলু মিয়া। তিনি বলেন, “বাবা সমাজের কথা ভাবতে গিয়ে গরিব লোকের ছেলে-মেয়েদের পড়াতে গিয়ে আমাদের সংসারের অভাবের কথা কখনো ভাবেননি। তার এই একগুঁয়েমির জন্য আমাদের অনেকদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এখন আমার দুই ভাই ভালো রোজগার করি, বাবাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরাতে নিষেধ করি কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেন না। পড়ানোই তার নেশা।”
বাগুরিয়া গ্রামের জেলে গগেন্দ্রনাথ দাস (৫২) বলেন, “আজ থেকে ২০ বছর আগেও লুত্ফর মাস্টার আমার ছেলেকে এক টাকা দিন প্রাইভেট পড়িয়েছেন। এখন আমার ছেলে চাকরি করে। এখনও তিনি আমার ছোট মেয়েকে এক টাকা দিন প্রাইভেট পড়ান। তার মত সৎ মানুষ দেশের সব এলাকায় থাকলে দেশটা ভালোভাবে চলতো।”
মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে লুত্ফর রহমান নিজ থেকেই বলেন, “একটা শিক্ষিত মেয়ে হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষিত মেয়েরা সমাজের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। মেয়ে শিক্ষিত হলে সেই পরিবার আলোকিত হবে, আর পরিবার আলোকিত হলেই না দেশ আলোকিত হবে। লোকে বলে ‘like father like son’ কিন্তু আমি বলি ‘like mother like country.”
“আমি ১৯৭৯ সাল থেকে ছাত্র পড়াই। লেখাপড়া- শিক্ষাদানের মধ্যেই আমার সব থেকে আনন্দ। আমি যতদিন বেঁচে আছি এইভাবেই শিক্ষাদান করবো”, বলেন লুত্ফর রহমান।
গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন-উর রশিদ (ইদু) বলেন, “লুত্ফর মাস্টার সম্পর্কে গাইবান্ধার সবাই অবগত। সমাজ ও দেশের সেবা করতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্টের শিকার হয়েছেন। এক বছর আগেও তার থাকার ভালো ঘর ছিল না কিন্তু ২০১৮ সালে ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দের টাকা থেকে একটা টিনের ঘর করে দিয়েছি।”
গাইবান্ধা সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায় বলেন, “আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের সন্তানদের পরিয়ে আসছেন। ওনাকে বলেছি যেকোনো সমস্যায় পড়লে যেনো আমার কাছে আসেন, আমি তাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করবো। কিন্তু কোনো সাহায্য চাইতে তিনি এখনও আমাদের কাছে আসেননি। তিনি খুবই ব্যক্তিতসম্পূর্ণ এবং সৎ মানুষ।”
Comments