আমাদের অনেকেরই স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়!
মঞ্চে আলো এসে পড়তেই নড়েচড়ে বসেন সবাই। মুগ্ধ হওয়ার বাসনা নিয়ে স্থিরচোখ মঞ্চের দিকে। শুরু হয়ে যায় সংলাপ আর আবহসংগীতের লহরী। অন্য কোনদিকে মনোযোগ সরানো যায় না। সব মনোযোগ মঞ্চের দিকে টেনে রাখে। মঞ্চের মধ্যেই একটু একটু করে রচিত হতে থাকে নতুন একটা উপন্যাস। নাটকের আলো, কলা-কুশলী, আবহসংগীত ও পোশাক রচনা করতে থাকে সেই উপন্যাস। দর্শকরা একটু একটু করে পাঠ করতে থাকেন তা। উন্মোচিত হতে থাকে অধ্যায়ের পর নতুন অধ্যায়। আমরা চলে যাই ১৯৮৫ সালের ভেতরে। সেখান থেকে কখনো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। আবার ১৯৭৩ সালের মধ্যে ঢুকে পড়ি অনায়াসে। এমন মুগ্ধ যাত্রা চলতেই থাকে। তবে অনেক দর্শক উচ্চকিত আবহসংগীতের কারণে সংলাপের সবটা গ্রহণ করতে পারেননি। তবে পরিবেশনার মুগ্ধতার কারণে অনেককিছু চাপা পড়ে যায়।
শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’-র ওপর ভিত্তি করে নাটকটি পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। শিল্পের অভিনব সংমিশ্রণে নাটকটি তৈরি করেছেন নির্দেশক। মেধা আর অন্তরের গভীর থেকে কাজ করেন তিনি। মঞ্চে সে ছাপটা স্পষ্ট পাওয়া যায়। কী এক যাদুর ঘোরে আটকে রাখেন। কখনও আলোর খেলা দিয়ে, কখনো আবহসংগীতের মূর্ছনায় আর কখনো অভিনয়ে। পরিবেশনার যাদুতো রয়েছেই। এখানেই একজন নির্দেশকের সার্থকতা। দর্শকদের কীভাবে আটকে রাখতে হয় এটা ভালো জানেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। এর ফলে আবহসংগীতের ঝনঝনানির ছাপিয়ে যায় পরিবেশনার অভিনবত্বে। নির্দেশক সেটা খুব যত্ন করে করেছেন।
উপন্যাসে শহীদুল জহিরের টেক্সট কী ছিলো তা ভুলে যেতে হবে। কেননা, সৈয়দ জামিল আহমেদ সেই টেক্সট নিজের মতো করে রচনা করেছেন মঞ্চে। সবকিছুতেই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে পুরো মঞ্চজুড়ে। এটি একজন নির্দেশকের আরেকটি বড় সার্থকতা। সবকিছু ভুলিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই নির্দেশকের। অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার নাম ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখতে জানেন। অনেক দর্শক উচ্চ আবহসংগীতের কারণে বিরক্ত হয়েছেন। তবে মঞ্চের একজন নতুন দর্শক হিসেবে মুগ্ধ করেছে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
আমাদের রাজনীতির অনেক বাস্তব বিষয় উঠে এসেছে নাটকটির মাধ্যমে। সেই বিষয়গুলো অনেক সযত্নে মঞ্চে বুনেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। নাটকের পটভূমি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারকে। সেখানকার দিনরাতগুলো উঠে এসেছে নাটকে। লক্ষ্মীবাজারের সেই গল্পটি যেনো পুরো বাংলাদেশেরই গল্প। লক্ষ্মীবাজার ছাড়িয়ে পুরো বাংলাদেশের চিত্র দেখতে পাই ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মাধ্যমে। রচয়িতা শহীদুল জহির এখানেই সবার থেকে আলাদা। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নাটকের অসামান্য গল্পে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের অবস্থান ছিলো বিতর্কিত, মুক্তিযুদ্ধের পর তাদের অনেকেই বিভিন্ন কৌশলে হয়ে উঠে দেশের সেবক। এই কৌশলটিই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে নাটকের পরতে পরতে।
নাটকে আমরা এমন অনেক চরিত্রের সন্ধান পাই যাদের দেখে শিউরে উঠি, মন খারাপ করি, অপমানিত হই। এখানে দেখি বদু মওলানা- বদরউদ্দিন মাওলানা। মুক্তিযুদ্ধে যার অবস্থান নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিলো। দেশ স্বাধীনের পর তাদের অনেকেই রাজনীতির মাধ্যমে হয়ে উঠে দেশের সেবক। চুপ হয়ে যেতে হয়। আজিজ পাঠানের মতো মানুষের জন্ম হয় বাংলাদেশে। যাদের ক্ষমার কারণে অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছে এদেশ। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছুই নেই’ সংলাপটি নষ্ট রাজনীতির অনেককিছুই স্পষ্ট করে দেয় আমাদের চোখের সামনে।
আবদুল মজিদের মতো আমাদের অনেকেরই স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। অসহায়, ভয়ার্ত চোখে অনেক কিছু অবলোকন করি। চুপচাপ অনেককিছু সইয়ে যায়। বুকের খুব গভীরে দেশের পতাকা, দেশপ্রেম নিয়ে পথ হাঁটি। অসংখ্য মোমেনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে আমাদের চারপাশে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বলি হয়েছিলো। নতুন মোমেনার জন্মে এগিয়ে চলে বাংলাদেশ।
তবে ‘স্পর্ধা’ প্রযোজনায় কিছু ঘাটতি চোখে পড়েছে ভীষণ করে। এমন একটি প্রযোজনার সুযোগ পেয়ে তার ব্যবহার ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেননি। অনেকের দুর্বল অভিনয় চোখে পড়েছে। আরেকটু মনোযোগী হলে হয়তো উতরে যাওয়া যেতো। আশা রাখি আগামীতে বিষয়গুলো তারা মাথায় রাখবেন। তবে যারা মঞ্চের আলো-পরিকল্পনা, পোশাক-পরিকল্পনা ও কোরিওগ্রাফি করেছেন তাদের সবাইকে মাথানত শুভেচ্ছা। তারা অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছেন নাটকটি। তবে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মতো প্রযোজনায় তাদের আরও বেশি মনোযোগের প্রয়োজন অনুভব করছি।
Comments