‘পশু আজ মানুষেরই নাম...’

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। ছবি: সংগৃহীত

সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে পৃথিবী নামক নরকের মায়া ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন নুসরাত। তাকে বাঁচানো গেলো না। তিনি বেঁচে থাকলে অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি জীবন্ত মূর্ত প্রতীক হতে পারতেন, কিন্তু তা হলো না। তনুর পথ ধরে তিনিও চলে গেলেন অজানা, না ফেরার দেশে।

নুসরাত মফস্বলের মেয়ে। ঢাকা থেকে প্রায় ১৭০ মাইল দুরে সে এক অজপাড়া গায়ের মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি মাদ্রাসায় পড়তেন বলেই হয়তো সমাজের বিভিন্ন স্তরে সোচ্চার গলাগুলো খুবই ম্রিয়মাণ।

বরং উল্টো চিত্র দেখি। ‘ধর্ষক’ মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলার মুক্তির দাবিতে একদল মেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। একটি মহল তার মুক্তির দাবিতে মিছিল করেছে।

যদি গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহ দেখি তবে আমাদের চোখে কী ধরা পড়ে? যদি না আমাদের চোখে ছানি পড়ে থাকে। স্থানীয় রাজনীতির কলুষতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তা ধরে রাখার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অর্থের দৌরাত্ম, পেশীশক্তির মহড়া, আইনের শাসনের অভাব, জবাবদিহির অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রভাব আরও অনেক কিছু।

একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের যখন এই অবস্থা, সেই দেশে নুসরাত তার শিক্ষকের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হবেন, সহপাঠীদের লাগানো আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে মৃত্যুর শয্যায় শুয়ে শুয়ে বিচারের দাবি জানাবেন- এটিই সত্য, এটিই বাস্তবতা। আপনি কি অন্যকিছু আশা করেন?

নুসরাতকে বাঁচাতে না পারাটাই স্বাভাবিক। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা না বরং ঘুণে ধরা সমাজ, পচে যাওয়া বিবেক, মরে যাওয়া মনুষ্যত্ববোধ- নুসরাতকে হত্যা করেছে। এই সমাজে নুসরাতের বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক।

নুসরাত মরে গিয়ে প্রমাণ করেছেন তার গায়ে যে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি আসলে প্রতীকী আগুন, আসল আগুন লাগানো হয়েছে সমাজের গায়ে, রাষ্ট্রের শরীরে।

এই আগুন দেখে আমরা চুপসে থাকি। দিনের পর দিন আমার-আপনার বোনেরা ধর্ষিত হচ্ছেন আর আমরা ফেসবুক গরম করি বিচারের দাবি জানিয়ে, ধর্ষককে ধিক্কার দিয়ে। আর সবশেষে বলি- আমরা লজ্জিত, ক্ষমা করিস বোন, ভালো থাকিস পরপারে।

আর কতো ক্ষমা আমরা চাইবো? আমরা তো ক্ষমার অযোগ্য হয়ে গেছি। আমরা কি অথর্বই থেকে যাবো? আমরা কি প্রতিবাদ করতে পারবো না? আমরা কি প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি?

সাদা ব্যান্ডেজে সারা শরীর মোড়ানো নুসরাতের, তার মাঝেই উঁকি দিচ্ছে পায়ের আঙ্গুলে মেহেদির রঙ।

নুসরাত আমরা এতো অন্যায় করেছি যে আপনার মেহেদির রাঙা পা ধরে ক্ষমা চাইতেও লজ্জা পাচ্ছি।

আমরা চিনতে না পারলেও নুসরাত কিন্তু এ সমাজ চিনে গিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের প্রায় ৮০ বছর আগের লেখা একটি গানের কথা বারবার মনে আসছে, কিন্তু গুনগুনিয়ে গাইতেও পারছি না।

“তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ

এ কি অভিশাপ, নাই প্রতিকার

মিথ্যারই জয়, আজ সত্যের নাই তাই অধিকার...”

“এ কি হলো, পশু আজ মানুষেরই নাম...”

আরও পড়ুন:

আগুন মেয়ে

Comments

The Daily Star  | English

Fund crunch hits Rohingyas hard

A humanitarian crisis in Cox’s Bazar Rohingya camps is brewing in the face of funding shortage for the refugees and more arrivals from the conflict-ridden Rakhine state of Myanmar.

10h ago