ঢাবিতে বৈশাখী আয়োজনে ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনায়ও দু’টি তদন্ত কমিটি
চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মলচত্বরে দুই দিনব্যাপী লোকসংগীত উৎসব ও কনসার্টের আয়োজন করেছিলো আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
যে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠন করতে দেখা যায় ঢাবি কর্তৃপক্ষকে। এখন ঢাবিতে কতগুলো তদন্ত কমিটি কাজ করছে, কয়টি রিপোর্ট দিয়েছে, কয়টি রিপোর্ট দিবে, সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।
১২ এপ্রিল দিবাগত ১টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই আয়োজনকে ঘিরেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মীর অভিযোগ, পুরো ঘটনাটির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ জড়িত। এর জেরে পূর্বনির্ধারিত আয়োজনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, “এটা শিক্ষার্থীদের একটি প্রোগ্রাম ছিলো। সংগঠন তো তাদের ব্যাপার। ওইদিনই সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মাইনুল করিমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন তারা দেখবেন বিষয়টা।”
কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে কী-না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না, আমরা কোনো সময় বেঁধে দেইনি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা প্রতিবেদন জমা দেবেন, এই মর্মে কমিটিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর অভিযোগ, এ ঘটনায় ছাত্রলীগের একাংশ জড়িত। আপনি বিষয়টি জানেন কী-না? জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, “অভিযোগ নিয়ে আগেই কথা বলার সুযোগ নেই। প্রতিবেদন আসুক, তারপর আমরা দেখবো যে কারা অভিযুক্ত, কে অভিযোগ করেছে।”
তদন্ত কমিটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার জন্য সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মাইনুল করিমকে ফোন করা হলে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিনি এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি পাননি। তাই বাকি দুই সদস্যের ব্যাপারে কিছু জানেন না। কমিটিতে নিজের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে জেনেছেন শুধু।
এ বিষয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, “আমি যতদূর শুনেছি যে, আয়োজনটিতে বড় কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির স্পন্সর ছিলো প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো। সেই টাকা-পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায়, তাদের একপক্ষ আরেক পক্ষকে কোণঠাসা করার জন্য এই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে।”
“তবে, এই ঘটনা শোনার পরেই আমি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছি যে, পহেলা বৈশাখের আগের রাতে এমন একটি সাম্প্রদায়িক হামলার যদি উপযুক্ত বিচার না করা হয়, তাহলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আরও ঘটতে থাকবে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের খুঁজে বের করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী বলেন, “মূল দল আওয়ামী লীগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারাই জড়িত, তাদের যে পরিচয় হোক না কেনো, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার প্রধান চার নেতার বৈঠক হয়েছে জানিয়ে রাব্বানী বলেন, “ওই ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম ও বি এম মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার দায়িত্ব নিয়েছেন।”
আগামী এক-দুইদিনের মধ্যেই এ ঘটনার সর্বশেষ তথ্য জানা যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে উদ্দেশ্যেই হোক, যার আদেশেই হোক, যারা এই কাজ করেছে তাদের শাস্তি হবে।”
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িত ১২ জনের নাম পাওয়া যাওয়ার কথা জানান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী কী-না? জানতে চাইলে রাব্বানী বলেন, “তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন কয়েকজনও আছে। তবে তাদের আমরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলতে চাই না।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মাহবুবুল আলম হানিফের কাছে অভিযুক্তদের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে রাব্বানী বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এখনই সেসব নাম আপনাকে দিতে চাচ্ছি না।”
ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এই ১২ জনের বাইরেও আরও কেউ রয়েছে কী-না, সেটিই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে রাব্বানী বলেন, “এই ঘটনায় জড়িত কেউ ছাত্রলীগের হয়ে থাকলেও, তারা আর ছাত্রলীগ করতে পারবে না।”
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে মূল্যায়ন না করায়, এমনকি আয়োজনের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে ডাকসুর ভিপি নুরসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে গোলাম রাব্বানী বলেন, “এগুলো ভিত্তিহীন কথা। এই আয়োজনের সমন্বয়ক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে শোভনের আগেই কথা হয়েছে। তবে, ডাকসু নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে শোভন এমনিতেই একটু হতাশায় ছিলো। শোভনও এই জিনিসটি এভাবে চায়নি। শোভনের দোষ রয়েছে বলা যাবে না। এখানে অতি-উৎসাহী একটা গোষ্ঠী প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখিয়েছে। আমি কখনোই বলবো না, এই কাজ শোভনের নির্দেশনায় হয়েছে। শোভনের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এখানে বড় ধরণের একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”
“বৈশাখের মতো একটি আয়োজনকে বানচালের মতো কাজ যারা করেছে, এর আগেও তারা বিভিন্ন ধরণের সমস্যা করেছে। তবে, এবার আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবোই”, জানান তিনি।
কী ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে? জানতে চাইলে রাব্বানী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেহেতু জড়িতদের নাম মাহবুবুল আলম হানিফের কাছে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অধিকতর তদন্তে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, ডিজিএফআই কাজ করছে।”
ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, “এ বিষয়ে প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিকভাবে তদন্ত চলমান রয়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে ওই লোকসংগীত উৎসব ও কনসার্ট অনুষ্ঠানটি স্থগিত হয়ে গেলেও, আয়োজনটি আবার অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন রাব্বানী ও সাদ্দাম।
তবে, এসব বিষয়ে জানার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:
ঢাবি ছাত্রলীগের একাংশের বিরুদ্ধে মঞ্চ ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার অভিযোগ
Comments