শামীম ওসমান ও এসপির দ্বন্দ্বের পর এবার আলোচনায় ‘মধ্যাহ্নভোজ’

Shamim Osman
১৪ এপ্রিল ২০১৯, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদের বাসভবনে এক টেবিলে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করেন এমপি শামীম ওসমান। সেসময় রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

মাত্র এক সপ্তাহ আগেই কর্মী সমাবেশ করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদকে সর্তক বার্তা দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি একেএম শামীম ওসমান। কিন্তু, সর্তক করার মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসপির বাস ভবনে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ করেছেন সেই এমপি। আর এ নিয়ে নগরজুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে।

১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ফতুল্লার চাঁদমারী এলাকায় পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে পুলিশ সুপারের বাস ভবনে বর্ষবরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাঙালি খাবারের আয়োজন করা হয়। যেখানে ছিলো পান্তা ভাত, মাছ ভাজা, বিভিন্ন রকম ভর্তা, ফল, চটপটি ও কফির আয়োজন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর পৌনে ২টায় অনুগত রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাকর্মীদের নিয়ে এসপির বাসভবনে যান শামীম ওসমান। পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ সেখানে শামীম ওসমানকে স্বাগত জানান।

সেখানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর দুপুরে এসপির বাসভবনের ভেতরে এক টেবিলে বসে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন শামীম ওসমান। সেসময় তিনি ও পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ পাশাপাশি চেয়ারে বসেন। পরে বিকাল ৩টায় সেখান থেকে সবাই চলে আসেন।

সেসময় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল প্রমুখ।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এসপি হারুন অর রশিদের বাস ভবনে মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করলেও দুজনের মধ্যে তেমন কোনো গভীর কিংবা এককভাবে কোনো আলোচনা হয়নি। তারা দুজনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। সেখানে বর্ষবরণের আয়োজন উপভোগ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “তানভীর আহমেদ টিটু (শামীম ওসমানের শ্যালক) ও কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলকে (শামীম ওসমানের অনুগত নেতা) নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে, দুজনের নামে মামলা হয়েছে। পরবর্তীতে দেখা যায় কোনো মামলা হয়নি। প্রশাসনের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যে ভুল বোঝাবুঝি ছিলো তা মিটে গেছে। তাই আমরা মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করেছি।”

মধ্যাহ্নভোজে শামীম ওসমানের অংশগ্রহণ বিষয়ে এসপি হারুন অর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “পুলিশ প্রশাসন থেকে এমপি, মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেককে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো। তিনি (শামীম ওসমান) এসেছিলেন শুভেচ্ছা জানাতে।”

শামীম ওসমান ১০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ফোন রেখে দেন।

আর এ বিষয়ে শামীম ওসমানের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এসপির বাসভবনে যাওয়া নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা জানান, দুজনের মধ্যে প্রকাশ্যে যে লড়াই শুরু হয়েছিলো তা এখন কিছুটা স্তিমিত হলেও এখন মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে।”

উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল দুপুরে শহরের ইসদাইর এলাকার বাংলা ভবন কমিউনিটি সেন্টারে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে জরুরি কর্মী সভায় শামীম ওসমান ও তার অনুগত নেতাকর্মীরা পুলিশ প্রশাসনকে সর্তক করে বক্তব্য দেন। আর সেখান থেকেই মূলত শামীম ওসমানের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়।

‘নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী পরিবারকে ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’ ব্যানারে ওই সভা থেকে পুলিশের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে স্থানীয় সাংসদ একেএম শামীম ওসমান বলেছিলেন, “নারায়ণগঞ্জে পোশাকধারী কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না। পোশাকধারী কোনো সন্ত্রাসীর স্থান নারায়ণগঞ্জের মাটিতে হবে না। পোশাকধারী একটি বাহিনী নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে চাঁদাবাজি করছে।”

এর মধ্যে সভাস্থলে ‘এসপি হারুনের পদত্যাগ চাই’, ‘নারায়ণগঞ্জকে গাজীপুর হতে দেওয়া হবে না’, ‘এসপি হারুন ঘুষখোর’-সহ নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়। তখন এমপি শামীম ওসমানসহ সিনিয়র নেতারা তাদের নিবৃত্ত করেন।

পরে শামীম ওসমান বলেন, “উত্তেজিত হবেন না। যদি অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হয় তাহলে নারায়ণগঞ্জের মাটিতে চাড়া নাচায়া দিব। এক সেকেন্ড সময় দিব না। ইতোমধ্যে আমাদের নেতারা বলছেন, গণপদত্যাগ করবে। কিন্তু, আমি বলি এতো উত্তেজিত হওয়ার কিছু নাই। মশা মারতে কামান দাগাতে পারবো না। আগামী ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যেই টের পাবেন।”

এ সমাবেশের আগে শামীম ওসমানের সমর্থিত নেতা হিসেবে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম পুলিশের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ২৯ মার্চ তার বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের বাদী হয়ে জিডি করেন। এরপর গত ১ এপ্রিল রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পাগলায় মেরি এন্ডারসনে বিপুল পরিমাণ মদ ও বিয়ার উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, এ ব্যবসায়ী শামীম ওসমানের শ্যালক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ টিটু জড়িত। ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের শীর্ষ সন্ত্রাসী কথিত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মীর হোসেন মীরুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে যার বিরুদ্ধে ৪টি হত্যা, একটি অস্ত্র, একটি মাদক, দুটি চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার এবং নিরীহ মানুষের উপর হামলাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে। মীরু মূলত শামীম ওসমানের রাজনীতি করে।

এছাড়াও, ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক কাউন্সিলর মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান মুন্নাকে মসজিদের টাকার হিসাব নিয়ে সংঘর্ষের ফলে হাতকড়া পড়িয়ে আটক করা হয়েছিলো। এরই মধ্যে পাগলায় প্যারাগন মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের মারধরের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন পাগলা বাজার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সভাপতি শাহ আলম টেনু।

এর প্রেক্ষিতে সভায় এমপি শামীম ওসমান বলেছেন, “আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই আমরা ভয় পাবো সেটা ভাবার কারণ নাই। মনে রাখতে হবে আমরা এখনো বুড়ো হই নাই। আমাদের নিয়ে খেইলেন না, খেলাইয়েন না। আমরা এখনো জোয়ান আছি। মন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় জুয়ার মামলা দিবেন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আমার আত্মীয়কে মদের মামলা দিবেন। এসব দিয়ে আমাকে কাবু করতে পারবেন না।”

এর প্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, “মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, জুয়া ও অবৈধ বালু উত্তোলনসহ এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে সেটা অব্যাহত থাকবে। যখন অভিযান চলবে এতে সবাই খুশি হয় না। কেউ না কেউ ঘটনার স্বীকার হবে। সবাইকে খুশি করা সম্ভব না। আমাদের পুলিশের চাকরিটাই এমন যে সবাইকে খুশি করা যায় না। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে সেটা যে যতো বড় শক্তিশালী হোক না কেনো।”

পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের মাদক, সন্ত্রাস, জুয়ার আসর, তেল চোরসহ বিভিন্ন অভিযানে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, মামলায় যাদের নাম এসেছে, তাদের অনেকেই শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কিংবা নিকটাত্মীয়। যার প্রেক্ষিতে শামীম ওসমান পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেই সভার আয়োজন করেন। ফলে সম্প্রতি পুলিশ প্রশাসন পুরো পরিস্থিতি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দিয়েছে তাতে কোথায়, কখন, কোন অভিযানে কারা ধরা পড়েছেন, কারা ক্ষুব্ধ হয়েছে তার বিবরণ রয়েছে।

এরপর গত ৯ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে লাঙ্গলবন্দ পুণ্যস্নান উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আসেন শামীম ওসমানের বড় ভাই ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান। তিনি বলেন, এসপির সঙ্গে বসেছি। বরফ গলানো শুরু করে দিবে।

সভায় এসপি হারুন অর রশিদ বলেন, “কোনো এমপির সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমাদের মধ্যে বরফই নেই, সেখানে গলানোর প্রশ্নই উঠে না। আমাদের কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। আমরা মাদক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও বিভিন্ন জায়গায় জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়েছি। অভিযানে যদি কেউ আটকে যায় তাহলে কোর্ট থেকে তাকে আপনারা জামিন করিয়ে আনবেন। কিন্তু আমাদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নাই।”

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

Every beat of my patriotic heart, every spark of my nation building energy, every iota of my common sense, every conclusion of my rational thinking compels me to most ardently, passionately and humbly appeal to Prof Yunus not to resign from the position of holding the helm of the nation at this crucial time.

6h ago