একজন অ্যাসাঞ্জ ও মুক্ত সাংবাদিকতা

পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই কম বেশি বিভিন্ন রকমের অপকর্ম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার নিজের প্রয়োজনে। হোক সেটা গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক অথবা স্বৈরতান্ত্রিক। নামের ভিন্নতার কারণে অপরাধের মাত্রা বা ধরনের ভিন্নতা হয়। এই যা।
Julian Assange
১১ এপ্রিল ২০১৯, লন্ডনের ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই কম বেশি বিভিন্ন রকমের অপকর্ম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার নিজের প্রয়োজনে। হোক সেটা গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক অথবা স্বৈরতান্ত্রিক। নামের ভিন্নতার কারণে অপরাধের মাত্রা বা ধরনের ভিন্নতা হয়। এই যা।

রাষ্ট্রের সকল ভালো কাজ নিয়ে যেমন নাগরিকরা গর্ববোধ করে, প্রচার করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে যার যার অবস্থান থেকে। তেমনি একটি রাষ্ট্রের সকল অপকর্মের খতিয়ান তার নাগরিকের জানার অধিকার আছে। জানতে হবে কারণ তার কষ্টার্জিত টাকা কি মানুষের কল্যাণে নাকি মানুষের প্রাণ হরণে ব্যয় হচ্ছে। কারণ একজন সচেতন নাগরিক কখনোই তার অর্থ অন্যের ধ্বংসে ব্যয় হতে দিতে পারেনা।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়ে যায় সাধারণ মানুষের জানার বাইরে এবং একইসঙ্গে সারা পৃথিবীতে সাংবাদিকতার গুণগত মানের অবনমনের ফলে সেসব অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে যায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ যোজন দূরে।

এই রকম একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ২০১০ সালে অর্থাৎ প্রায় এক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি অতি সংবেদনশীল গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্ব আলোচনার পাদপ্রদীপে আসেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। রাতারাতি বনে যান জগৎখ্যাত নায়ক। সাধারণ মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়েছিলো এক বিশাল অজানা তথ্য ভাণ্ডারের।

অ্যাসাঞ্জ যেসব নথি ফাঁস করেছেন, তার বেশিরভাগে যুদ্ধের নামে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, নির্যাতন, গোপনে সামরিক অভিযানের মতো বিষয়গুলো ওঠে আসে। শুধু ইরাক ও আফগান যুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাঁচ লাখ নথি প্রকাশ করা হয়।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের অপকর্মের খতিয়ান পাবলিকের হাতে তুলে দেন তিনি। শুরু হয় দুনিয়াব্যাপী তোলপাড়। আর এতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে মার্কিনীরা। তাদের মোড়লীপনার গোমর ফাঁস করে দিয়েছে। অ্যাসাঞ্জের মতো এতোটা বেকায়দায় কেউ ফেলতে পারেনি আমেরিকাকে- একদম ‘টু দ্যা পয়েন্টে হিট’ যাকে বলে।

নিজেদেরকে দাবী করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ‘সোল এজেন্ট’ কিন্তু উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা দাড়ায় ‘দুষ্কর্মের সোল এজেন্ট’ হিসেবে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর বিস্তর নৃশংসতার খতিয়ান বিশ্ববাসীর সামনে এক নতুন আমেরিকাকে হাজির করে অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস।

সংবাদপত্র ইন্ডাস্ট্রি যখন সাড়া পৃথিবীতেই হুমকির মুখে, মিডিয়া যখন ওয়াচডগের ভূমিকা থেকে ল্যাপডগের ভূমিকায় ঠিক সেসময় অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সাংবাদিকতা কি?

যদিও অনেকেই এটাকে সাংবাদিকতা বলতে নারাজ। কিন্তু আমরা দেখেছি যে উইকিলিকসের তথ্য ব্যবহার করে বিশ্বের মোটামুটি সব গণমাধ্যমই সংবাদ প্রকাশ করেছেন। অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস সাংবাদিকতা নাকি গুপ্তচরবৃত্তি এ বিতর্ক চলবে, বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে গবেষণাও হবে। তাই এ বিতর্ক ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। তবে অ্যাসাঞ্জ বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী সরকার ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সাধারণ মানুষের বাহবা কুড়িয়েছেন ঠিকই। শত্রুও তৈরি করেছেন অনেক।

শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে অ্যাসাঞ্জ আশ্রয় নেন লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে। সেখানে সাত সাতটি বছর কাটে তার। সম্প্রতি ইকুয়েডর অ্যাসাঞ্জের আশ্রয় বাতিল করে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে আমরা দেখলাম, যুক্তরাজ্যের পুলিশ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে ঢুকে অ্যাসাঞ্জকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে বস্তার মতো করে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়েছে।

সাত বছর চেষ্টা-তদবির করার পর অ্যাসাঞ্জকে আমেরিকা তাদের কব্জায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আপাতত ‘দোস্ত বাড়ি’তে বেঁধে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে লন্ডনের এক আদালত অ্যাসাঞ্জকে ৫০ সপ্তাহ কারাদণ্ড দিয়েছেন জামিনের শর্ত লঙ্ঘন করে লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থান করায়। অ্যাসাঞ্জের সামনে যে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে তা এখন দিবালোকের মতো সবার সামনে স্পষ্ট।

কিন্তু অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের ধারক, বাহক, মানবাধিকারেরে সোল এজেন্ট ব্রিটেন বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলো তার আসল ও কদর্য চেহারা। যেভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো, যেভাবে তাকে টানা-হেঁচড়া করে গাড়িতে উঠানো হলো, তাতে মনে হলো অ্যাসাঞ্জ একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী, আইএসের শীর্ষ সন্ত্রাসী।

যেভাবে অ্যাসাঞ্জকে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছে, তাতে মনে হয়ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। সভ্য ও ভদ্র গণতন্ত্রীকামী ব্রিটেন কিংবা আমেরিকা কিংবা ইউরোপ এখন থেকে কোন মুখে গণতন্ত্রের ছবক দিবে, মানবাধিকারের দাবী জানাবে, কীভাবে বলবে বাকস্বাধীনতা মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং তা পুরণে রাষ্ট্র বাধ্য কিংবা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নাই মানে দেশে গণতন্ত্র নাই।

Comments