ঋণখেলাপি হবো- এটাই আমার অ্যাম্বিশন
পত্রিকার পাতা কিংবা অনলাইন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- সব জায়গাতেই বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা ঋণখেলাপি নিয়ে। অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী- সবাই আলোচনা করছেন, বলছেন খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে দেশের ব্যাংকিং খাত বাঁচাতে হলে, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে।
অর্থনীতির সব কঠিন কঠিন সংজ্ঞা একপাশে রেখে আসুন একটু সহজ ভাষায় বুঝে নেই ঋণখেলাপি কী, এবং কারা ঋণখেলাপি?
আমরা সবাই (ঋণখেলাপিরা ছাড়া!!) জানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা একসময় সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হয়। এই ‘একসময়’ বলতে হতে পারে ঋণ গ্রহণের এক বছর, দুই বছর বা পাঁচ-দশ বছর পর। এই সময়ের মধ্যে কোনো ঋণগ্রহীতা যদি সুদ-আসল, বা আলাদা করে শুধু সুদ বা আসলের অল্প পরিমাণও ব্যাংককে দিতে না পারেন, তখন তারা ঋণখেলাপি হয়ে যান। তখন ঐ ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি বলা হয়।
তাহলে ঋণখেলাপি কারা? তারা সমাজের কোন শ্রেণি-পেশার লোক? তারা কীভাবে যুক্ত হচ্ছেন এ প্রক্রিয়ায়?
সম্প্রতি সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ২ লাখ ৬৬ হাজার ১১৮ জন। তিনি শীর্ষ ঋণখেলাপিদের নামও সংসদে বলেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ কি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা? না, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কিন্তু, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ পাওয়া আর সময় মতো মওকুফ করে নেওয়া।
একজন মানুষ ঋণখেলাপি হতেই পারেন। কিন্তু, ঠিক কী কারণে তিনি খেলাপি হলেন, এর সত্যানুসন্ধান খুব জরুরি। এদের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি কতোজন, ব্যবসায়িক কারণে খেলাপি কতোজন?
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেশের রাঘব বোয়ালরাই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। আরও খোলাসা করে বললে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ও নৈতিকভাবে প্রচণ্ড দুর্বল, তাদেরই একটি বড় অংশ ঋণখেলাপি। মনে রাখতে হবে, দেশের আপামর জনসাধারণ কিন্তু ব্যাংকের ঋণ ঠিক মতো পান না। আর যদি ঋণ পানও কোনো কিস্তি কোনো কারণে দিতে না পারলে সবধরনের আইনি ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ই, তার উপর থার্ড পার্টি দ্বারা হেনস্তা করে ঋণ আদায় করা হয়।
এইতো কিছুদিন আগে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মোচাগড়া গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর আব্দুল মতিনকে জেলে পাঠানো হয়েছিলো ১৭ মাসের বিদ্যুৎ বিল বাকির মামলায়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশে দেখা গেলো মতিনের বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগই ছিলো না। এটি একটি উদাহরণ মাত্র যে, খেলাপি না হয়েও সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হয়? আর খেলাপি হলে তো কথাই নেই।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তো সম্প্রতি বলেই দিয়েছেন, “ঋণখেলাপি হলেই যদি সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠানো হয়, তাহলে দেশ চলবে না।” কথা সত্য! তবে এ পর্যন্ত কতোজন ঋণখেলাপি জেলে গেলো তা জানতে পারলে ভালো লাগতো, আলোচনাটা একটু জমতো।
এবার আসি খেলাপি ঋণ কমানো কেনো জরুরি সে আলোচনায়। বড় বড় উদ্যোক্তাদের, শিল্পপতিদের অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থার একটি ভূমিকা রয়েছে। সেখানে বড় সমস্যা হিসেবে সামনে আসছে ঋণখেলাপি হওয়ার বিষয়টি। সরকারও এখন তা স্বীকার করছেন।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এক আলোচনা সভায় বলেছেন, দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংক খাতকে খেলাপি মুক্ত করতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত চার দশকে কয়েকগুণ বেড়েছে। এটি থামানো যাচ্ছে না।
যেকোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম মুল চালিকাশক্তি হলো ভালো ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এক সময় দেশের উদ্যোক্তাদের অর্থ জোগানে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয় এবং ব্যাংকিং খাত ছিলো বিশ্বমানের। কিন্তু, জেনারেল জিয়ার আমল থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একধরণের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয় যার মাধ্যমে এদেশে ঋণখেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়। এরপর আমাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলা। যতোদিন গিয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতও ফোকলা হওয়া শুরু করেছে। এখনতো ঋণখেলাপিদের বৃহস্পতি তুঙ্গে। দেশের অর্থনীতির ঝাণ্ডা এখন তাদের হাতে। অবস্থা কুছ পরোয়া নেহি।
আমাদের মনে রাখতে হবে খেলাপি ঋণ হলো অর্থনীতির ‘ইন্টারনাল ব্লিডিং’, বাংলায় যাকে বলি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ বেশি হলে মানুষকে যেমন বাঁচানো যায় না ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়ে, ঠিক তেমনি যতোই রিজার্ভ থাকুক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বাঁচানো যাবে না খেলাপি ঋণের কারণে।
তাই এখনই ঋণখেলাপিদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে, নইলে বিপদ আসন্ন।
ছোটবেলায় স্কুলে আমাদের রচনা লিখতে হতো ‘ইউর এইম ইন লাইফ’। কেউ লিখতেন ডাক্তার হতে চান, কেউ হতে চান ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা পাইলট। যদি ঋণখেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ না হয় তবে হয়তো আজকের বাচ্চারা লিখবেন বড় হয়ে ঋণখেলাপি হতে চান। আর বড় হয়ে তারা গুনগুনিয়ে গান গাবে ‘আমি ঋণখেলাপি হবো- এটাই আমার অ্যাম্বিশন।’ কারণ এর চেয়ে সহজে ধনী হওয়ার আর কোনো পথ নেই!
Comments