‘দিন যায় কথা থাকে’

সংগীতজ্ঞ মান্না দে’র যখন জন্মশতবার্ষিকী পালন চলেছে বিশ্বব্যাপী, তখন তারই ভাবশিষ্য সুবীর নন্দী গভীর ঘুমে অচেতন হাসপাতালের বেডে। মান্না দে দেহ রেখেছেন সাত বছর আগে। তাই হয়তো তাড়াহুড়ো করছিলেন গুরুর কাছে যাওয়ার জন্য। চলে গেলেন ভাবগুরুর কাছে।
Subir Nandi
সুবীর নন্দী (১৯৫৩ – ২০১৯)

সংগীতজ্ঞ মান্না দে’র যখন জন্মশতবার্ষিকী পালন চলেছে বিশ্বব্যাপী, তখন তারই ভাবশিষ্য সুবীর নন্দী গভীর ঘুমে অচেতন হাসপাতালের বেডে। মান্না দে দেহ রেখেছেন সাত বছর আগে। তাই হয়তো তাড়াহুড়ো করছিলেন গুরুর কাছে যাওয়ার জন্য। চলে গেলেন ভাবগুরুর কাছে।

কথা-গান-স্মৃতি-প্রেম... সবই থাকল... সশরীরে থাকলেন না সুবীর নন্দী!

মান্না দে’র কঠিন কঠিন গানগুলো সাবলীলভাবে গাওয়ার সাহস সুবীর দা ছাড়া বাংলাদেশে আর কে কবে সাহস দেখিয়েছিলেন! দাদা পারতেন কারণ তার ছিলো উচ্চাঙ্গসংগীতের ভীত। মান্না দে’র সঙ্গে দাদার একটি বড় মিল হলো গায়কী। উচ্চাঙ্গসংগীত সাধারণ মানুষের কাছে কখনোই খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলো না। কিন্তু, দাদা এখানেই উনার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। উনার জনপ্রিয় সব গানই কঠিন কঠিন সব রাগ-রাগিণী বা ঠাটের উপর ভিত্তি করে গাওয়া। সুবীর নন্দীর পরে আর কেউ এ জায়গায় সফল হননি।

ক্লাসিক্যালের বাইরে দাদার আরেকটা জায়গায় অসম্ভব দখল ছিলো। আর সেটা হলো লোকসংগীত। যদিও তার সংগীতের শুরু নজরুল গীতি দিয়ে, কিন্তু, তিনি যৌবনের একটা সময় কাটিয়েছেন লোকগান সংগ্রহ করে আর তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে জনপ্রিয় করার কাজে।

১৯৬০ এর দশকের বেতার গায়ক, সুরকার বিদিত লালের সংস্পর্শে এসে ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো’, ‘সিলেটে প্রথম আজান ধ্বনি’, ‘প্রাণ কান্দে মোর’, ‘মরিলে কান্দিসনে আমার দায়’, ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’, ও ‘আমি কেমন করে পত্র লিখি’ এসব গান মাঠে-ময়দানে শহরে গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন।

ক্লাসিক্যাল আর ফোকগানের এ মেলবন্ধন খুব কমই দেখা যায়। কারণ শিল্পীরা সবসময় একটি নিজস্ব ঘরানা তৈরি করতে চান। দাদাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে যেহেতু বড় হয়েছেন ক্লাসিক্যাল গান শিখে আর লোকগীতি শুনে তাই দুটোকেই তিনি এক সঙ্গে করে সংগীতকেই নিয়ে গিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়।

দাদার শৈশব কেটেছে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। হবিগঞ্জের মানুষ। আমারও বেড়ে উঠা হবিগঞ্জে। তাই একধরণের সখ্যতা আমার ছিলো উনার সঙ্গে। ২০১৭ সালের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি অনেকক্ষণ বললেন লোক সংগীতের কথা, লোকশিল্পীদের কথা। বলেছিলেন আজম ফকির, আরকুম শাহ, শীতালং শাহসহ আরও কয়েকজন গুণী বাউলশিল্পীর সৃষ্টির কথা- যেগুলো অনেকে গাইছেন সুর বিকৃত করে এবং গীতিকার ও সুরকার হিসেবে শিল্পীদের নাম উল্লেখ না করে বা সংগৃহীত বলে। তিনি সিলেটের আরেক বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রামকানাই দাশ এর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। বলতেন উনার মতো রত্ন সারাজীবন আড়ালে থেকেই কাজ করে গেছেন, প্রচার পাননি।

সুবীর দা’কে ভেঙ্গেচুরে নতুনভাবে নিয়ে আসলেন আরেক গুণিজন হুমায়ুন আহমেদ। দুজনের রসায়নটা ছিলো খুবই চমৎকার। হুমায়ুন আহমদের জীবনে ফ্লপ বলে যেমন কিছু নেই, ঠিক তেমনি নেই সুবীর দারও। হুমায়ূনের সঙ্গে তার যুগলবন্দীতে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক কালজয়ী গান। দুজনের আরেকটি কাকতালীয় মিল ছিলো।

রোজার প্রথম দিনে হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে দেখা করার জন্য পাড়ি জমালেন যেখানে হুমায়ুন আহমেদ তার জন্য অপেক্ষা করছেন দীর্ঘ সাতবছর ধরে। কারণ সাত বছর আগে তো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নামজাদা বাদশাহ অচিন দেশের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছিলেন রমজানের প্রথম দিনেই।

কতোটা জনপ্রিয় বা মানুষের কাছে কতোটা ভালোবাসার পাত্র সুবীর দা- তা আজ প্রকাশ পাচ্ছে সব জায়গায়। ফেসবুক, টিভির সংবাদ, পত্রিকার পাতা আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল- সব জায়গায় সুবীর দা’কে নিয়ে এতো সংবাদ, এতো স্মৃতিচারণ, এতো স্ট্যাটাস তা দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু আছে।

এই যে এতো আলোচনা এতো স্মৃতি রোমন্থন, আচ্ছা সুবীর দা লোক কেমন ছিলেন? উনার ভাবনার ক্ষেত্র কেমন ছিলো? সবকিছুর উত্তর তো তিনি নিজেই দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গিয়েছেন যে তিনি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছিলেন, দিন গেলেও যে কথা থাকে তা মনে করিয়ে দিয়েছেন, বেদনার কথা জানিয়েছেন বোবা পাহাড় আর মেঘের কান্নায়, আবার এও বলেছেন যে আমার চোখ দুটোতো পাথর নয়। ভালোবাসার আকুতি জানিয়েছেন কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, উড়ালপঙ্খীকে নিয়ে উড়াল দিয়েছেন আবার তিনিই গেয়েছেন হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই।

গত দুই দশকে আমি দাদাকে যতোটা দেখেছি তাতে তিনি সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন বলেই মনে হয়েছে। সারাজীবন সাধনা করেছেন তাই তার কণ্ঠে বয়সের ছাপ পড়েনি কখনো। যেহেতু সারাজীবন সাধনা করেছেন, তাই সংগীতে সাধনার বিকল্প পথ তিনি সব সময় নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন রিয়েলিটি শোয়ের নামে শিল্পীরা ক্ষণিকের বিনোদন হয়তো দিচ্ছে কিন্তু টাকা আর খ্যাতি লোভে শিল্পী আর শিল্পী হয়ে উঠেন না। বলতেন- তাদের নিজেদের মৌলিক কোনো গান নাই, সবই হলো অন্যর গান।

নিজের হাতেই গড়া স্বার্থের শৃঙ্খল, হয়ে গেছে আজ তো পৃথিবীর সম্বল, জানিয়েছিলেন তিনি আগেই। তাইতো চলে গেলেন অসময়ে। তিনি তার ইচ্ছাটা আগেই বলে গিয়েছিলেন যে যদি কোনোদিন আমার পাখি আমায় ফেলে উড়ে চলে যায় একা একা রব নিরালায়।

সুবীর নন্দী, সুরের নন্দনেও ছিলেন বীর। তা বোধ হয় তার পরম শত্রুরাও স্বীকার করবেন। আর এ কারণেই তিনি থাকবেন হাজার বছর ধরে লক্ষ জনতার কণ্ঠে।

নিশ্চয়ই এখন ভালো আছেন দাদা। মান্না দে, দাদার আরেক গুরু বিদিত লাল দাস, শ্রদ্ধাভাজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সবার সঙ্গে হয়তো গানের আড্ডা বসাবেন ওপারে, হয়তো বসেও গেছে আড্ডা।

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago