খেলাপি ঋণ ছাড়াল ২ লাখ কোটি টাকা

অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

সুশাসনের অভাব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এই পরিসংখ্যান গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের শিকার হওয়া ব্যাংক সেক্টরের নাজুক অবস্থাকে তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয় গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এতদিন যা স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর কারসাজিতে চাপা পড়েছিল।

এর আগে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। মূলত তার পদত্যাগের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০০৮ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। এরপর থেকে আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি বাড়তে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তা তারা বিশ্বাস করেন না। কারণ গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেসব অডিট করেছে, সেগুলো সঠিকভাবে করেছে কিনা তা নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে।

তিনি বলেন, 'বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'

তার ভাষ্য, 'বাংলাদেশ ঋণের শ্রেণিবিন্যাস বা প্রভিশনিংয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে না। আমরা যদি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতাম তাহলে এই খাতের এই দুরবস্থা দেখতে হতো না।'

তিনি অভিযোগ করেন, 'সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রভিশনিং পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনেন। ব্যাংক খাতের জন্য যা ছিল একটি বড় ধাক্কা।'

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'গত কয়েক বছরে এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেছে।'

তার পরামর্শ, 'নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে আরোপের আগে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা বন্ধে জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।'

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তার ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরিয়ে আনবে। আশা করছি আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাতকে পুনরুদ্ধার করা যাবে।'

এদিকে জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।

কারণ তারা ধারণা করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো ভুয়া দলিল ও অনিয়মের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু, সরকার পতনের পর এই ঋণের একটি অংশ খেলাপিতে পরিণত হবে।

তারা বলেন, শুধু এস আলম ও তার সহযোগীরা একাই ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। আগামী মাসগুলোতে এসব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে চান না। তাদের এই প্রবণতা মন্দ ঋণের বোঝা আরও বাড়াতে পারে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা অধিকাংশ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, ফলে এসব ঋণ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আদালতের নির্দেশে রাইট-অব ঋণ, পুনঃতফসিল ঋণ বিবেচনায় নিলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

তার ভাষ্য, 'আগের সরকার ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাইট-অব ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ সংকটাপন্ন সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এরপর থেকে রাইট-অব ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণের তথ্য প্রকাশ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তাই এই অঙ্ক আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সাবেক সরকার।

আগের সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ শতাংশ।

(এই প্রতিবেদনটি  ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

CA likely to announce election date within 4-5 days: Mostafa Jamal

He made the remarks after a meeting between Prof Yunus and leaders of 12 political parties at the state guesthouse Jamuna

51m ago