‘বাস কোম্পানিতে আমার শেয়ার আছে জানতাম না’

আছাদুজ্জামান মিয়া
আছাদুজ্জামান মিয়া। ফাইল ফটো

পঞ্চাশোর্ধ্ব নূর আলম মিলন বলেন, তিনি কখনো গাজীপুরের শ্রীপুরে যাননি। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার কামারগ্রাম গ্রামের এই ব্যক্তি ঢাকার পরিবহন কোম্পানি মৌমিতা পরিবহন লিমিটেডের নামও কখনো শোনেননি বলে জানান।

কিন্তু তার নামে দাখিল করা ট্যাক্স রিটার্নে দেখা যায়, শ্রীপুরের কেওয়া মৌজায় তার আট বিঘা জমি আছে এবং সাভার থেকে নারায়ণগঞ্জে চলাচলকারী পরিবহন লাইনে তার এক হাজার শেয়ার আছে।

ওই পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামান এবং পরিচালক তাদের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত। কোম্পানিটির ১৪০টি বাস রয়েছে।

'আল্লাহর কসম, শেয়ার থাকা তো দূরের কথা মৌমিতা পরিবহন সম্পর্কেই আমি কিছু জানি না। গাজীপুরেও আমার কোনো জমি নাই। আমি কখনো ট্যাক্স রিটার্নই দাখিল করি নাই,' গত ৩০ আগস্ট তার গ্রামের বাড়িতে দ্য ডেইলি স্টারকে কথাগুলো বলছিলেন নূর আলম।

আফরোজার ভাইয়ের নাম নূর আলম। বর্তমানে তদন্তকারীরা আছাদুজ্জামানের পরিবারের সম্পদের উৎস খুঁজতে গিয়ে নুর আলমের সম্পদের উৎসও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

নুর আলম কামারগ্রামে থাকা একজন সাধারণ মানুষ। থাকেন গ্রামেই তার পৈত্রিক বাড়িতে। বড় ছেলে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিক। নুর আলম নিজেও ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাহরাইনে প্রবাসী শ্রমিক ছিলেন।

তিনি বলেন, পৈতৃক জমির ইজারার টাকা এবং স্থানীয় গোপালপুর বাজারের একটি দোকান ভাড়ার সামান্য আয় দিয়ে আমার পরিবার চলে।

কিন্তু তার নামে দাখিল করা ২০২২-২৩ সালের আয়কর রিটার্নে দেখা যায়, তার সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকারও বেশি। তবে ডেইলি স্টারের হাতে আসা নথিতে দেখা গেছে যে নুর আলমের ট্যাক্স ফাইলে ব্যবহৃত স্বাক্ষরের সঙ্গে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্বাক্ষরের মিল নেই।

'অন্য কেউ হয়তো আমার নাম ব্যবহার করেছে। আমি জানি না সে কে,' বলেন নূর আলম।

তার ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করা হয়েছিল খুলনায়। নূর আলম জানান, খুলনায় কোনোদিন থাকেননি তিনি। তবে সেখানে ২০০৭-২০০৯ পর্যন্ত পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক ছিলেন আছাদুজ্জামান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, এসবের পেছনে রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার হাত। তাদের মতে, নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে সাবেক এই পুলিশ সদস্য তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের নামে বিভিন্ন সম্পত্তি কিনেছেন।

যেমন-- নথি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তার শ্যালক হারিছুর রহমান সোহান এবং ভাতিজা ইব্রাহিম শেখের এখন অন্তত ২৪ কোটি টাকার সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে।

নূর আলমের মতো, ইব্রাহিমের ট্যাক্স রিটার্নও খুলনা থেকে দাখিল করা হয়েছিল। যদিও তিনি ২০০৫-২০২১ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২০২২-২৩ আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য থাকাকালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যে স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন, তার সঙ্গে তার ট্যাক্স ফাইলের স্বাক্ষরের কোনো মিল পাওয়া যায়নি।

দুদকের নজরদারির আওতায় থাকা ইব্রাহিম আলফাডাঙ্গার গোপালপুর বাজারে 'সবুজ ছায়া' নামে একটি বহুমুখী সমবায় পরিচালনা করেন। উচ্চ সুদের বিনিময়ে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায় বিনিয়োগে আছাদুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক।

আছাদুজ্জামানের পরিবারের 'অবৈধ সম্পদের' বিষয়ে দুদকের তদন্ত সম্পর্কে সূত্র জানায়, আছাদুজ্জামানের পক্ষে পুলিশ বাহিনীতে ও অন্যত্র চাকরির বিনিময়ে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে ইব্রাহিম জড়িত থাকতে পারেন।

গত দুই সপ্তাহ ধরে যোগাযোগের জন্য ফোন কল ও টেক্সট মেসেজ দেওয়া হলেও ইব্রাহিম কোনো সাড়া দেননি।

পুলিশ ও পরিবহন সেক্টর সূত্রে জানা গেছে, আসাদুজ্জামানের শ্যালক হারিছুর রহমান সোহান ঢাকায় সাবেক ডিএমপি প্রধানের বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা করতেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে অন্তত ১০ জন গ্রামবাসী জানান, সোহান ২০১০ সালে শ্রমিক হিসাবে সৌদি আরবে গিয়েছিল। মাত্র দুই বছরের মাথায় প্রায় খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন।

তার এখন স্বর্ণের ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় ৪৩ শতক জমি এবং ঢাকার শান্তিবাগে অন্তত একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

স্বর্ণ ও পরিবহন ব্যবসায়ী এবং কো-ফ্ল্যাট মালিকরা জানিয়েছেন, এগুলোর সম্মিলিত মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। 

সোহানের একজন সাবেক ব্যবসায়িক অংশীদার জানান, সোহানের বেশিরভাগ বিনিয়োগ আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবার থেকে আসে এবং তিনি শুধুমাত্র তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখাশোনা করেন।

নথিতে দেখা যায়, ঢাকার দুটি বাস কোম্পানি গুলশান চাকা (এক হাজার শেয়ার) ও মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডে (দেড় হাজার শেয়ার) ৪৩ বছর বয়সী সোহানের শেয়ার রয়েছে, যেখানে আসাদুজ্জামানের স্ত্রী, ছেলেসহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনেরও বিনিয়োগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক ব্যবসায়িক অংশীদার জানান, অধুনালুপ্ত মধুমতি পরিবহন লিমিটেডের ২৫ শতাংশ শেয়ারও ছিল সোহানের হাতে।

আছাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে রুট পারমিট দেওয়ার দায়িত্বে থাকা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) প্রধানও ছিলেন। প্রতিটি কোম্পানি গঠন এবং রুট পারমিট নেওয়া হয় তখন। আছাদুজ্জামান ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিএমপি প্রধান ছিলেন।

চলতি বছরের মে মাসে আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় ৪৩ ডেসিমেল জমি কিনেছিলেন সোহান যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৪২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। তবে স্থানীয়রা জানান, ওই প্রাইম লোকেশনে বর্তমানে জমির দাম ৪ কোটি টাকার কম নয়।

ফ্ল্যাট মালিক সমিতির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজধানীর শাহজাহানপুরের 'শান্তিবাগ কটেজে' সোহানের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে যেখানে তিনি গত বছর পর্যন্ত ছিলেন।

বর্তমানে তিনি বেইলি রোডের গোল্ড প্যালেসে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন বলে জানান ফ্ল্যাটের মালিক খন্দকার নাসির উদ্দিন।

২০২২ সালে সোহান ঢাকার নিউমার্কেটে 'পিওর গোল্ড লিমিটেড' নামে একটি সোনার দোকান খোলেন। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান সোহান কোম্পানির মোট এক লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩০ হাজার শেয়ারের মালিক। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের কাছে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার বোন রহিমা পারভীন (৭ হাজার ৫০০ শেয়ার) এবং তিন কাজিন মিত্তাফুর রহমান, আনিসুর রহমান হিটলু ও সেলিমুজ্জামান-- একসঙ্গে ৫৩ হাজার শেয়ারের মালিক।

তার দোকানের আশেপাশে স্বর্ণের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিন ব্যক্তি জানান, অন্তত ১০ কোটি টাকার প্রায় এক হাজার তোলা স্বর্ণের অলঙ্কার নিয়ে পিওর গোল্ডের দোকান খুলেছে। সোহান একাই প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন, বাকি টাকা অন্য অংশীদাররা বিনিয়োগ করেছেন।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই তিন ব্যবসায়ী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে গিয়ে, একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে সোহান ঘুষের মাধ্যমে, বিশেষ করে পুলিশে নিয়োগ এবং পোস্টিং ব্যবসার মাধ্যমে তার সম্পদ গড়েছেন।

যোগাযোগের জন্য ফোন কল ও টেক্সট মেসেজ দিলেও সোহান কোনো জবাব দেননি।

Comments

The Daily Star  | English
 Chhayanaut ushers in 1432 at Ramna Batamul with Raag Bhairav

Chhayanaut ushers in 1432 at Ramna Batamul with Raag Bhairav

As the sun rose over Dhaka, Chhayanaut’s Pahela Baishakh celebration for the Bengali year 1432 began at Ramna Batamul. The theme of Chhayanaut's Pahela Baishakh celebration this year is "Amar Mukti Aloy Aloy" (my freedom lies in light). Through this theme, Chhayanaut aims to convey a message of hope, resilience, and renewal.

1h ago